আলহামদুলিল্লাহ্।

আজকে যে বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছি, তা আমাদের আশেপাশে প্রায়ই চোখে পড়ে। তবুও আমরা তা খুব কমই অনুধাবন কিংবা লক্ষ করি। কারণ আমাদের পার্থিব ব্যস্ততা ও লাগামহীন চাহিদা এ বিষয়টিকে প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। আর এ বিষয়টি হচ্ছে মহান আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে আমাদের প্রতি ‘বারাকাহ্’। যা আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি বিশেষ এক দয়া। তাই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা, যেন আমরা একটু ভাবতে চেষ্টা করি ইনশা আল্লাহ্।

IIRT Arabic Intensive

‘বারাকাহ্’ শব্দটিকে আমরা ‘বরকত’ হিসেবেই বেশি জানি ও ব্যবহার করি। যার অর্থ প্রাচুর্য কিংবা প্রবৃদ্ধি। তাই আমরা অনেকের জন্য দু’আ করতে গিয়েও শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। যেমন, বারাকাল্লাহু ফিক (অর্থ: আল্লাহ্ আপনার মাঝে বরকত দিন), আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু (অর্থ: আপনার উপর শান্তি, আল্লাহ্‌র রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক)। এভাবে শব্দটির বহুল প্রচলন থাকলেও আমরা এর বাস্তবতা অনুধাবন খুব কমই করে থাকি। অথচ বাস্তবে অনুধাবন করার মাঝেই শব্দটির সার্থকতা নিহিত রয়েছে।

যেমন, গ্রামে একজন আলিমের (মাসজিদের ইমাম কিংবা মুয়াজ্জিন) মাসিক ৫০০০-৬০০০ টাকা বেতন দিয়ে ৫ জনের সংসার হাসিমুখে চালিয়ে নেয়া, একটি দ্বীনদার পরিবারে অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও কোনোরকম হাহাকার পরিলক্ষিত না হওয়া, একজন ব্যবসায়ীর অল্প পুঁজিতেই সততার সাথে অনেক মুনাফা অর্জন করা ইত্যাদি সবই আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে আমাদের প্রতি বারাকাহ্। এছাড়া দাম্পত্য জীবনে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাওয়া, ছাত্রজীবনে স্মরণশক্তি তীক্ষ্ণ হওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে উন্নতি লাভ করাও আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে আমাদের প্রতি বারাকাহ্। যদিও আমরা তা ব্যক্তিগতভাবে কিংবা দলীয়ভাবে অর্জন করেছি বলে দাবি করি, তবে তা মূলত আল্লাহ্‌রই দয়া। কারণ আমরা জানি, আমাদের উন্নতি কিংবা প্রাপ্তির ক্রেডিট আমরা নিজেরা নিতে চাইলেও আমাদের অপ্রাপ্তি কিংবা ব্যর্থতার দায়বদ্ধতা নিতে চাই না। কিন্তু আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা এই দু’টিকেই একসাথে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে ঘোষণা দেন এবং তা কখনো আমাদের প্রতি দয়া করে, কখনো আমাদের পরীক্ষা করে, আবার কখনো আমাদের কর্মফল হিসেবেই দিয়ে থাকেন। আর এই ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্‌রই। যেমনটি তিনি বলেন-

আল্লাহ্‌ তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে তিনি ছাড়া কেউ তা সরাতে পারবে না। আর তিনি যদি তোমার কল্যাণ করতে চান, তবে তো সব কিছুই করার তাঁর ক্ষমতা রয়েছে।  [সূরাহ আল আন’আম (৬): ১৭]

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ হতে আমরা নিয়মিত কিছু হিডেন (লুকায়িত/আবৃত) বারাকাহ্ পেয়ে থাকি। তবে প্রায় সময়ই এগুলো আমাদের বোধগম্য হয়ে উঠে না। আর এরকম দু-একটি বারাকাহ্ উপলব্ধি করতেই এই লিখা। এই যেমন- কাউকে একটা লম্বা সময়ের জন্য বড় ধরনের অসুস্থতা থেকে বাঁচিয়ে রাখা কিংবা মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করা, কাউকে অধিক সন্তান-সন্ততি দেওয়া কিংবা কাউকে অপ্রয়োজনীয় ভোগ-বিলাসিতা থেকে দূরে রাখা ইত্যাদি সবই হিডেন বারাকাহ্। এমন আরো অনকে কিছুই রয়েছে যেগুলো আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়, অথচ প্রতিটাই আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে আমাদের প্রতি বিশেষ নিয়ামাহ্।

এখন যদি আমরা আফসোস করে বলি- হায়! আমার বেতন এত হলো না কেন, আমি কেন গরীব পরিবারে জন্ম নিয়েছি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু, তখন আমাদের ভাবতে হবে আমি যদি বড় কোনো রোগে আক্রান্ত হতাম, তখন কিন্তু আমার অনেক বেতনের চাকরিটা দিয়েও টিকে থাকতে পারতাম না। কিংবা আমি ধনী পরিবারে জন্ম নিয়েও কোনো এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারতাম। আর তখনই আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা থেকে প্রাপ্ত হিডেন বারাকাহগুলো আমাদের চোখে পড়বে, ইনশা আল্লাহ্। আর এ বিষয়ে আল্লাহ্‌ তা’আলার পক্ষ হতে আমাদের জন্য বিশেষ রিমাইন্ডার-

অতএব তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে? [সূরা আর-রহমান (৫৫): ১৩]

বারাকাহ্ কিংবা বরকত শব্দটির সাথে অন্য যে বিষয়গুলো জড়িত আছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হচ্ছে- তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ও শুকরিয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্‌কে ভয় করা, তাঁর উপর ভরসা রাখা এবং তাঁর নিয়ামাতসমূহের প্রতি শুকরিয়া প্রকাশ করা। আর এ তিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলো ব্যতীত আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে বরকত লাভ করা কল্পনাতীত। আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন-

জনপদের অধিবাসীগণ যদি ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তবে আমি তাদের প্রতি আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা (সত্যকে) প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তাদের কৃতকর্মের বদলাতে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। [সূরাহ আল আ’রাফ (৭): ৯৬]

এই আয়াতের শুরুতেই যে শর্ত দুটি রয়েছে, তা হলো ঈমান ও তাকওয়া। যখন শর্ত দুটি পূরণ হবে, তখনই আল্লাহ্‌র পরবর্তী অংশে বর্ণিত বরকত (বারকাহ্) পেয়ে যাবো। আর ‘আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বার’ বলতে যা বুঝানো হয়েছে, তা হলো আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ ও জমিন হতে ফসল উৎপাদন (তাফসীর ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য)। তবে এ দুটিকে আমরা বরকত হিসেবে খুব কমই গ্রহণ করি। কখনো বৃষ্টির তিক্ততা আর দেশীয় ফসলাদির অবজ্ঞা দিয়েই আমাদের অনুধাবন শেষ হয়। অথচ এগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়া ছিলো পূর্ববর্তীদের জন্য শাস্তিস্বরূপ।

আমাদের সন্তান-সন্ততি, আমাদের সম্পদ কিংবা আমাদের নিরাপত্তা সবই আমাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ নিয়ামাত। যেমনটি ফির’আউনের কবল হতে মুক্তি পাওয়া বনী-ঈসরাইলদেরকেও দিয়েছিলেন। যখন ফির’আউন বনী-ঈসরাইলদের উপর নানারকম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে মুক্ত করেন ও তাদের সম্পদে বারআকাহ্ দেন। কিন্তু তারা যখন আল্লাহ্‌র নিয়ামতগুলোর প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে শুরু করলো, তখন মূসা (‘আলাইহিস সালাম) তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন-

স্মরণ কর, যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করেন যে, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে (আমার নিয়ামাত) বৃদ্ধি করে দিবো; আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। [সূরাহ ইবরাহীম (১৪): ৭]

অর্থাৎ আল্লাহ্‌র দেওয়া নিয়ামাতগুলোকে যখন আমরা অবজ্ঞা করতে শুরু করবো কিংবা তা পেয়ে আল্লাহ্‌র প্রতি শুকরিয়া করবো না, তখন আমরা আর এগুলো পাওয়ার যোগ্য থাকবো না। ফলে এগুলো আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে, আমাদের অন্তরগুলো হয়ে উঠবে অতৃপ্ত, আমাদের মানসিকতা হয়ে যাবে ক্ষুধার্ত। ফলে আমাদের মাঝে বিরাজ করবে এক ধরনের হাহাকার, যা হয়তো কখনোই মিটবে না। আর এমনিভাবেই অকৃতজ্ঞ বান্দাদের প্রতি আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁর শাস্তি দিয়ে থাকেন।

তাই আমাদেরকে একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে পরিচয় দিতে আল্লাহ্‌র নিয়ামাতগুলোকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং শুকরিয়া প্রকাশ করতে হবে। আর তখনই আমরা হয়ে উঠবো প্রকৃত ধনী ব্যক্তি। যেমনটি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন-

ধনের আধিক্য হলে ধনী হয় না, অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী। (বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা: ৫১৭০)

এর দ্বারা পরিতুষ্ট হৃদয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর আপনি যখন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আপনার চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, আল্লাহ্‌র নিয়ামাতসমূহের জন্য শুকরিয়া প্রকাশ করবেন, তখন আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলাও আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দিবেন। আর তা কেমন হতে পারে? এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন-

মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো চক্ষু দেখেনি, কোনো কান শুনেনি এবং যার সম্পর্কে কোনো মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পারো, “কেউ জানে না, তাদের জন্য তাদের চোখ শীতলকারী কী জিনিস লুকানো আছে।” (সূরাহ সাজদাহ ৩২:১৩)। [বুখারী, মুসলিম; আল লু’লু ওয়াল মারজান, হাদীস নং ১৭৯৮]

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive