সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ কতই না চমৎকার করে আমাদেরকে বানিয়েছেন। এক জোড়া চোখ দিয়েছেন, যেই চোখ দিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর এই ধরণীর রূপ দেখে আমরা মুগ্ধ হই। একটা উন্নত মস্তিষ্ক দিয়েছেন, যা দিয়ে আমরা কত জটিল জটিল ব্যাপারের সমাধান করি। তিনি আরও দিয়েছেন একটা সংবেদনশীল অন্তর, যার সুস্থতার উপরে কি না সমগ্র দেহের সুস্থতা নির্ভর করে। এই অন্তর দিয়ে আমরা কত অধরাকে যে স্পর্শ করি, কত না জানাকে যে জেনে ফেলি, তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহর দেওয়া এই নেয়ামতগুলির ব্যাপারে যদি গভীরভাবে কেউ চিন্তা করে, তাহলে তার অন্তর সীসার মতো শক্ত হলেও মুহূর্তের মধ্যেই মোমের মতো গলে যেতে বাধ্য হবে, যদি না মহান আল্লাহ তার অন্তরে মোহর মেরে দেন। আসলে মহান রবের শান যে কত বিশাল, আর তিনি যে কত মহিমাময়, তা বুঝতে চাইলে কোনো ডিগ্রি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না, মহান রবের অপরূপ এই সৃষ্টিজগতের দিকে একটু তাকালেই হয়। কী উত্তম এক পন্থায় তিনি রাত আর দিনের আবর্তন ঘটান! কত সূক্ষ্মভাবে তিনি সমগ্র মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন, যার মধ্যে সামান্যতম সময়ের জন্যও বিশৃঙ্খলা হয় না। এখন প্রশ্ন, সেই মহান সত্তা কি আমাদের এমনিই এমনিই সৃষ্টি করেছেন?? উত্তর হবে “না।” আল্লাহ নিজেই আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

অর্থ: আমি মানুষ ও জিন জাতিকে কেবলমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। [সূরাহ আয-যারিয়াত (৫১): ৫৬]

অর্থাৎ, আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে আসার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে মহান আল্লাহর ইবাদাত করা। তাঁর আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলে অনন্তকালের জীবনের আরাম আয়েশকে নিশ্চিত করা। মহান আল্লাহর আমাদের পৃথিবীতে পাঠানোর এই উদ্দেশ্যের অধীনে আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। সেটিও আল্লাহ বলে দিয়েছেন,

IIRT Arabic Intensive

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ

অর্থ: তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। [সূরাহ আলে ইমরান (৩): ১১০]

অর্থাৎ, আল্লাহ আমাদেরকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যাতে করে আমরা অপরের কল্যাণ সাধন করতে পারি। আর এই কল্যাণ আমরা কীভাবে সাধন করতে পারি, তা মহান আল্লাহ উপরের ওই আয়াতের শেষাংশেই বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ ۗ

তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।

অর্থাৎ, আমাদের শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার পিছনে প্রধান কারণ মানুষকে সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করার মাধ্যমে কল্যাণের পথে আহ্বান করা। আর এই কল্যাণের পথে আহ্বান বলতে একমাত্র ইসলামের পথে আহ্বানকেই বুঝায়। কেননা এই ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা প্রকৃত ভালোর আদেশ দেয় আর সকল প্রকার মন্দ থেকে দূরে থাকতে বলে। এছাড়াও মহান রবের নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র ধর্মও হলো ইসলাম। আল্লাহ বলেন

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ

অর্থ: নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। [সূরাহ আলে ইমরান (৩): ১৯]

অনেক সময় অনান্য মানবরচিত ধর্মের কোনো কোনো দিককে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে ভালো মনে হলেও একমাত্র ইসলাম ধর্মের বিধানগুলোই চিরন্তন আর অকাট্য। যুগের পর যুগ চলে যায়, কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিধানগুলির পরিবর্তন করা হয় না। পরিবর্তন করা যায় না। কেননা এ যে শাশ্বত এক বিধান, যা মহান আল্লাহই দিয়েছেন এবং তিনিই হেফাজত করেন। যেই বিধান শুধু যুগ না, শত বৎসর না, বরং কেয়ামত অবধি অপরিবর্তনীয় থাকবে। ফলে কেয়ামত পর্যন্ত ন্যায়-অন্যায়ের সঠিক মাপকাঠি একমাত্র ইসলামই দিতে পারে। অন্য কোনো মানবরচিত বিধানের কার্যকারিতা যুগ পেরোতেই বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই এই মানবরচিত বিধান থেকে মুখ সরিয়ে ইসলামের বিধান গ্রহণ করার মধ্যেই আমাদের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত আছে। সকল ভালাই কেবলমাত্র ইসলাম মানার মধ্যেই রয়েছে, আর তাই আমাদেরকে এই ইসলামের দিকেই দাওয়াত দিতে হবে।

এই দাওয়াতি কাজ করলে আমরা নবীদের দাওয়াতের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরতে পারবো, হতে পারবো উত্তম মুসলিম। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ

ওই ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহ্‌র প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন? [সূরাহ ফুসসিলাত ৪১:৩৩]

আর অপরপক্ষে আমরা যদি এই দাওয়াতি কাজকে ছেড়ে দেই, তাহলে আমাদের অবস্থাও ধীরে ধীরে বনী-ইসরাইলদের মতো হয়ে যাবে। ফলে পাকড়াও হতে হবে সর্বশক্তিমান আল্লাহর আযাবের কাছে। এই ব্যাপারে রাসূল ﷺ আমাদের অনেকবার সতর্ক করে গেছেন। যেমন, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত আছে, নবী ﷺ বলেছেন,

সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই তোমরা সৎকাজের জন্য আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তা’আলা শীঘ্রই তোমাদের উপর তাঁর শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তাঁর নিকট দু’আ করলেও তিনি তোমাদের সেই দু’আ গ্রহণ করবেন না। ( বুখারী, মুসলিম)

তাই আমাদের এই দাওয়াতি কাজ ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে যতটুকু পারি, ততটুকু কাজ আমাদের করতে হবে। নইলে অন্যান্য অবাধ্যদের মতো আমাদেরও করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। এই ব্যাপারে হাদীসে খুব সুন্দর একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে।

আমি সেই উদাহরণটি দিয়েই শেষ করছি, যার মাধ্যমে আমাদের অনেকের নিকট দাওয়াতের কাজের গুরুত্ব বুঝা সহজ হবে বলে মনে করি।

عَنِ النُّعمَانِ بنِ بَشِيرٍ رَضِيَ الله عَنهُمَا، عَنِ النَّبيّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: «مَثَلُ القَائِمِ في حُدُودِ اللهِ وَالوَاقعِ فِيهَا، كَمَثَلِ قَومٍ اسْتَهَمُوا عَلَى سَفِينَةٍ فَصَارَ بَعْضُهُمْ أعْلاها وَبَعْضُهُمْ أَسْفَلَهَا، وَكَانَ الَّذِينَ في أَسْفَلِهَا إِذَا اسْتَقَوا مِنَ المَاءِ مَرُّوا عَلَى مَنْ فَوْقهُمْ، فَقَالُوا: لَوْ أنَّا خَرَقْنَا في نَصِيبِنَا خَرْقاً وَلَمْ نُؤذِ مَنْ فَوقَنَا، فَإِنْ تَرَكُوهُمْ وَمَا أرَادُوا هَلَكُوا جَمِيعاً، وَإنْ أخَذُوا عَلَى أيدِيهِمْ نَجَوا وَنَجَوْا جَمِيعاً». رواه البخاري

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমায় অবস্থানকারী (সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে বাধাদানকারী) এবং ওই সীমা লঙ্ঘনকারীর (উক্ত কাজে তোষামোদকারীর) উপমা হলো এক সম্প্রদায়ের মতো, যারা একটি দ্বিতলবিশিষ্ট পানি-জাহাজে লটারি করে কিছু লোক উপর তলায় এবং কিছু লোক নিচের তলায় স্থান নিলো। (নিচের তলা সাধারণতঃ পানির ভিতরে ডুবে থাকে। তাই পানির প্রয়োজন হলে নিচের তলার লোকদেরকে উপর তলায় যেতে হয় এবং সেখান হতে সমুদ্র বা নদীর পানি তুলে আনতে হয়।) সুতরাং পানির প্রয়োজনে নিচের তলার লোকেরা উপর তলায় যেতে লাগলো। (উপর তলার লোকদের উপর পানি পড়লে তারা তাদের উপর ভাগে আসা অপছন্দ করলো। তারা বলেই দিলো, ‘তোমরা নিচে থেকে আমাদেরকে কষ্ট দিতে এসো না।’)

নিচের তলার লোকেরা বললো, ‘আমরা যদি আমাদের ভাগে (নিচের তলায় কোনো স্থানে) ছিদ্র করে দেই, তাহলে (দিব্যি আমরা পানি ব্যবহার করতে পারবো) আর উপর তলার লোকদেরকে কষ্টও দেবো না। (এই পরিকল্পনার পর তারা যখন ছিদ্র করতে শুরু করলো) তখন যদি উপর তলার লোকেরা তাদেরকে নিজ ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয় (এবং সে কাজে বাধা না দেয়), তাহলে সকলেই (পানিতে ডুবে) ধ্বংস হয়ে যায়। (উপর তলার লোকেরা সে অন্যায় না করলেও রেহাই পেয়ে যাবে না।) পক্ষান্তরে উপর তলার লোকেরা যদি তাদের হাত ধরে (জাহাজে ছিদ্র করতে) বাধা দেয়, তাহলে তারা নিজেরাও বেঁচে যায় এবং সকলকেই বাঁচিয়ে নেয়।’’ (বুখারি)

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive