আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসের যৌক্তিকতা লেখাটি টুডে ব্লগে পোস্ট করি। এক নাস্তিক তখন প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তাহলে আল্লাহ’র সৃষ্টিকর্তা কে?­” নাস্তিক লোকটি অতিঃশয় নিম্নমানের নাস্তিক। অনেকের কাছে নাস্তিকের প্রশ্নটি ‘যৌক্তিক’ মনে হবে, এমনকি আমাদের দেশের বেশিরভাগ আস্তিকরাও এই প্রশ্ন নিয়ে কনফিউজড বলেই আমার কাছে মনে হয়। নাস্তিক লোকটিকে কেন ‘নিম্নমানের’ বললাম তা লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে আশা করি যে কেউই বুঝতে পারবে আর এই প্রশ্নটিরও সমাধান পাবে।

পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির কিংবা কোন কিছু সৃষ্ট হতে আমি ঐ লেখাতে তিনটি সম্ভাবনা’র কথা বলেছি। যা মূলত সূরা তূরের (৫২ নং সূরা) ৩৫-৩৬ আয়াতের ওপর ভিত্তি করে। সম্ভাবনা তিনটি আবার রিপিট করছি।

IIRT Arabic Intensive

▪সম্ভাবনা-১: মানুষ ‘শূন্য’ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এটা যুক্তিতে টিকেনা। কারণ,  NOTHING CAN NOT CREATE ANYTHING! মূলত নাস্তিকেরা এই দাবিই করে থাকে।

▪সম্ভাবনা-২: মানুষ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে। এটাও যুক্তিহীন। কারণ, কেউ নিজেকে সৃষ্টি করতে হলে, আগে নিজেকে অস্তিত্বে আনতে হবে। তাই এটা যুক্তি বিহীন। শুধুমাত্র অন্যকেউ অলরেডি অস্তিত্বে আসলে সে দ্বিতীয়জনকে সৃষ্টির যৌক্তিকতায় আসবে।

▪সম্ভাবনা-৩: অনেক পর্ব কিংবা ধাপ পার হয়ে মানুষের আজকের এই অবস্থান। মানে অনেক ‘CAUSE’ & ‘EFFECT’ এর ফল মানুষ। মানে, C1 এসেছে C2 থেকে, C2 এসেছে C3 থেকে, এরুপ C3 এসেছে C4 থেকে। এভাবে C4 এসেছে Cn থেকে। কিন্তু, এই ভাবে চেইন (chain) চলতে থাকলে, বস্তুত CN হবে অপরিসীম এবং অনির্দিষ্ট। অথবা বলা যায়, Cn নিজেই কখনো অস্তিত্বে আসেনি, তাই C1 এর অস্তিত্বও অস্বীকার করা হয়, মানে মানুষের নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়। এরিস্টটল তাই এরুপ  INFINITE CAUSE & EFFECT থেকে মানব সৃষ্টি অসম্ভব বলেই সাব্যস্ত করেছেন।

তাহলে প্রশ্ন জাগে মানুষ/ বস্তু পৃথিবীতে এলো কোথা থেকে?

উত্তরঃ মূলত তখনই মানুষ কিংবা এই বিশ্ব অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসা সম্ভব যখন এসব এমন কেউ সৃষ্টি করেছে যিনি নিজে সৃষ্ট (created) নন। অন্যথায় ৩য় সম্ভাবনা টির মতো হবে, মানে স্রষ্টাকে যদি অন্য কেউ সৃষ্টি করে তবে ঐ বৃহত্তর স্রষ্টাকে আবার তার চেয়ে বৃহত্তর স্রষ্টা সৃষ্টি করলো এবং এভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু ৩য় সম্ভাবনাতেই ব্যখ্যা করেছি এইরকম ‘cause & effect’ অসম্ভব, যেটা আসলে সৃষ্টিকেই অবিশ্বাস করার শামিল। তাই শুধু মাত্র তখনই কোন কিছুর (সৃষ্টি’র) শূন্য থেকে প্রথমবারের মতো অস্তিত্বে আসা সম্ভব যখন এসব (সৃষ্টি) এমন কেউ সৃষ্টি করেছে যিনি নিজে সৃষ্ট নন। আবার বলি, যিনি নিজে কখনো অন্য কারও দ্বারা সৃষ্টি হননি।

এবার যুক্তিবিদ্যার ভাষায় কিছু কথা বার্তায় আসি। স্রষ্টা হচ্ছে তিনি যিনি সৃষ্টি করেন আর সৃষ্টি হচ্ছে তা যা সৃষ্ট হয়।

তাই যদি কোন স্রষ্টাকে অন্য কেউ সৃষ্টি করার দরকার হয় তবে ঐ স্রষ্টা আর স্রষ্টা থাকেনা তা সৃষ্টিতে রুপান্তরিত হয়, কেননা স্রষ্টা সৃষ্টি করে তাই তাঁকে স্রষ্টা বলা। তাই স্রষ্টার যদি কোন সৃষ্টিকর্তার দরকার হয় তবে তা মূলত ‘স্রষ্টার ডেফিনেশন’ এর সাথেই সাংঘর্ষিক।

যেমন কোন ‘পুরুষকে’ যদি প্রশ্ন করা হয় সে কতগুলো সন্তান প্রসব করেছে তবে তা অযৌক্তিক হবে। এবং কেউ যদি এই প্রশ্ন করে তবে তাকে পাগল বলা হবে কিংবা ব্রেইনলেস বলা হবে, কারণ পুরুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে কখনো সন্তান প্রসব করেনা। যে সন্তান প্রসব করে সে পুরুষ নয়। সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য নারীর দরকার হয়। স্রষ্টারও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে স্রষ্টা (creator) এমন কেউ যে নিজে সৃষ্ট নয় (uncreated)। তাই স্রষ্টার ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিকর্তা কে এই প্রশ্ন করাটাই অযৌক্তিক কারণ এই প্রশ্ন স্রষ্টার ডেফিনেশন এর সাথেই সাংঘর্ষিক।

“আল্লাহই হচ্ছেন সব কিছুর (একক) স্রষ্টা” (আল-কোরআন ৩৯:৬২)

“আল্লাহ তা’আলাই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন” (আল-কোরআন ৩৭:৯৬)

এখানে স্রষ্টা আর সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় জরুরি। স্রষ্টা ‘সৃষ্ট’ নন এবং সৃষ্টি ‘স্রষ্টা’ নয়। কোরআন বলছে, আল্লাহ ‘সবকিছু’র সৃষ্টি কর্তা, মানে সকল সৃষ্ট বস্তুর, সৃষ্ট মানে যার সৃষ্টির দরকার, যেমন-মানুষ, পাহাড়-পর্বত। আর আল্লাহ সৃষ্ট নয় তিনি স্রষ্টা, তাই তাঁর সম্পর্কে ‘সৃষ্ট’ শব্দটাই প্রযোজ্য নয়।

যেমন যদি বলা হয়, আল্লাহ কি সন্তান গ্রহণ করতে সক্ষম?

কথা হচ্ছে আল্লাহ’র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি সন্তান গ্রহণ করেনা। তাই যদি কোন স্রষ্টা সন্তান গ্রহণ করে তবে তিনি আর আল্লাহ থাকেন না। তাই এখানে এই প্রশ্নটাই অযৌক্তিক! “অথচ সন্তান গ্রহণ দয়াময়ের (আল্লাহ’র) জন্য শোভনীয় নয়” (আল-কোরআন ১৯: ৯২)

আবার কেউ যদি বলে, আচ্ছা আল্লাহ তো সব পারেন, তবে কি আল্লাহ তার ছেয়ে শক্তিশালী কাউকে তৈরী করতে পারেন?

উত্তর হচ্ছে আল্লাহই সর্বশক্তিমান। যখন বলা হচ্ছে ‘তার চেয়ে শক্তিশালী’ মানে আমরা আল্লাহ’র শক্তির সীমা নির্ধারন করে দিচ্ছি! যেটা আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সাথে অসামঞ্জস্য পূর্ণ। “আর তাঁর সমতূল্য দ্বিতীয় কেউ নেই” (আল-কোরআন ১১২: ৪)

একটা উদাহরণ দেয়া যাক- আমি যদি বলি, হূমায়ুনের চেয়ে আমার কাছে ৫ টাকা বেশি আছে। তার মানে আমি জানি হুমায়ুনের কত টাকা আছে। তার কাছে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আছে। আবার আমি যদি বলি রহিমের ওজনের চেয়ে আমার ওজন ২ কেজি বেশি। তার মানে এখানেও রহিমের ওজন এর নির্দিষ্ট সীমা আছে। সে জন্যেই তুলনা করা সম্ভব হচ্ছে।

কিন্তু আল্লাহ’র বৈশিষ্ট্যগুলোর কি কোন সীমা আছে? নির্দিষ্ট পরিমাপ রয়েছে?

যখন বলা হচ্ছে, আল্লাহ কি ‘তাঁর চেয়ে শক্তিশালী’ কাউকে সৃষ্টিতে সক্ষম, মানে এখানে আল্লাহ’র শক্তিকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। সহজ ভাষায়, ধরলাম, আল্লাহ’র শক্তির পরিমাপ ১৫। এখন আল্লাহ কি এমন কাউকে সৃষ্টি করতে সক্ষম যার শক্তির পরিমাণ ১৫ এর বেশী হবে? আসলে আল্লাহ’র শক্তি তুলনীয় নয়। “আর তাঁর সমতূল্য দ্বিতীয় কেউ নেই” (আল-কোরআন ১১২:৪)। তাই এই প্রশ্নটিই অবান্তর! কারণ আল্লাহ’র শক্তি (যে কোন বৈশিষ্ট্যে) তুলনাহীন, সেখানে ‘তার চেয়ে শক্তিশালী’ শব্দের তুলনাটিই অযৌক্তিক!

বিশ্বের কিছু তথাকথিত নাস্তিক আসলে মানুষের কিংবা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য দিয়ে স্রষ্টাকে ডিফাইন করতে চায়। এবং তাদের কু-মতলব হাসিল করার জন্য এসব কু-যুক্তি দেখায়। যেমন অনেকে বলে সাইন্সে স্রষ্টা বলে কিছু নেই, কিংবা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির কোন ফর্মূলাতে দিয়ে স্রষ্টাকে প্রমাণ করা যায়না। তাদের প্রতি-

▪প্রথম প্রশ্নঃ এসব ফর্মূলা তৈরি করা হয়েছে কি সৃষ্ট বিষয়কে ডিফাইন করার জন্য না স্রষ্টাকে ডিফাইন করার জন্য?

▪২য় প্রশ্নঃ এসব ফর্মূলা কি স্রষ্টাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বের করা হয়েছে না সৃষ্টকে?

▪৩য় প্রশ্নঃ সৃষ্ট কোন কিছুকে পরীক্ষা করে তৈরী করা ফর্মুলা/ বিজ্ঞান দিয়ে স্রষ্টাকে ডিফাইন করতে যাওয়া কতটুকু যৌক্তিক?

একটা উদাহরণ দেয়া যাক- মানুষ রোবট কে সৃষ্টি করল। রোবট সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রোগ্রাম, ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেক্ট্রিক বস্তুর সমন্বয়ে। এখন সাইন্স ফিকশনের মতো কল্পনা শুরু করলাম। কিছু রোবট একত্রিত হয়ে, তার স্রষ্টার (মানুষের) বৈশিষ্ট্য বের করা শুরু করল যারা মানুষকে কখনো দেখেনি। চলুন সংলাপটি শুনি-

১ম রোবটঃ তোমার কি মনে হয়, মানুষ মারা যায় কেন?

২য় রোবটঃ  সম্ভবত শর্টসার্কিটের ফলে।

১ম রোবটঃ শুনেছি, মানুষ  তরল পানিকে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করায়।

২য় রোবটঃ হুম। এরা কি জানেনা পানি ইলেক্ট্রনিক্স এর জন্য ক্ষতিকর?

১ম রোবটঃ মনে হয় জানেনা। এরা বোকা!

২য় রোবটঃ আচ্ছা মানুষকে প্রতিদিন কত ঘন্টা ইলেক্ট্রিক চার্জ নিতে হয়?

১ম রোবটঃ অনেক বেশী সময় হবে। কারণ এরা জটিল পদার্থ। আমাদের (রোবটদের) তো একটা ব্যাটারী অনেক দিন যায়, মানুষেরটা এতদিন যাওয়ার কথা না। তারা আমাদের চেয়ে কাজ বেশি করে।

এই হচ্ছে অবস্থা! আসলে রোবট যখন তার (অজৈব) শরীর এর বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষকে (জৈব শরীর) ব্যাখ্যা করতে যাবে, তা এই রকম হাস্যকর হবে। যদিও সত্যিকার অর্থে মানুষ প্রকৃত স্রষ্টা নয়, মানুষ এবং রোবট দু’টোই সৃষ্ট! আর আমরা তো এমন এক স্রষ্টার কথা বলছি যিনি জৈব অজৈব সব কিছুর প্রকৃত স্রষ্টা। তিনি ‘কিছুকে’ অনস্তিত্ব থেকে ‘অস্তিত্বে’ আনয়ন করেন। তার ক্ষেত্রে কীভাবে তাঁর ‘সৃষ্ট’ এই জগতের বৈশিষ্ট্য/ফর্মূলা দিয়ে তাঁকে (আল্লাহকে) ডিফাইন করব? পরীক্ষা করব?

মানে মানুষ মারা যায়, খাদ্য গ্রহণ করে, আলো দ্রুত বেগে ছুটে চলে, বিশ্বে সব কিছুরই শুরু এবং শেষ আছে! আর আমাদের বিজ্ঞানের ফর্মূলাগুলো এই সৃষ্ট জগত থেকে বিচার বিশ্লেষন থেকেই নেয়া। এসব বৈশিষ্ট্য তাই সৃষ্ট এই জগতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য স্রষ্টার ক্ষেত্রে নয়। বিশ্ব জগতের শুরু শেষ আছে, স্রষ্টার শুরু শেষ নাই! তাই বিশ্ব জগতের শুরু দেখে স্রষ্টার শুরুর প্রশ্ন করা বুদ্ধি বিবেক লোপ পাওয়া নাস্তিকদের কাজ।

এছাড়া এই বিশ্ব জগতের ফাইন টিউনিং দেখে পরিশেষে আমরা বলতে পারি, বিশ্ব সৃষ্টির জন্যই শুধু স্রষ্টা দায়ী নয়, বরং বিশ্বের এই ‘ফাইন টিউনিং’ একজন মহা শক্তিশালী পরিকল্পনাকারীর পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়।

আর সবশেষে বিস্ময়কর কোরআনে স্রষ্টার পরিচয়-

০১। (হে মোহাম্মদ), তুমি বল, তিনিই আল্লাহ, তিনি এক একক,

০২। তিনি কারোই মুখাপেক্ষী নন,

০৩। তাঁর থেকে কেউ জন্ম নেয়নি, আর তিনিও কারো থেকে জন্ম গ্রহণ করেন নি,

০৪। আর তাঁর সমতুল্য দ্বিতীয় কেউই নেই।

– আল-কোরআন ১১২: ১-৪ (হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ কর্তৃক অনুবাদকৃত, আল কোরআন একাডেমী লন্ডন কর্তৃক প্রচারিত)

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive