একই পরিবেশে বেড়ে উঠা একদল তরুণ কোনো এক বিকেলে উদাস মনে এক পথ ধরে চলছে। হঠাৎ তাদের সামনে দিয়ে একদল তরুণী অট্টহাসি হেসে চলে যাচ্ছে। আর তখনই তাদের কেউ মেয়েগুলোকে উদ্দেশ্য করে শিস দিয়ে বসলো, কেউ একটা অশ্লীল বাক্য ছুড়ে মারলো, আর কেউবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে তাকিয়েই থাকলো। কিন্তু কোনো একজন দৃষ্টি নিচু করে এক’পা, দু’পা করে সামনে এগিয়ে চললো, কিছুতেই যেন সে তার সতীর্থদের এমন আচরণ সহ্য করতে পারছিলো না। কিন্তু তার একার পক্ষে বাধা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই তার এই একলা চলা …।

বিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসা মেয়েগুলোর সাথে তাদের খালাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাইদের অনেকদিন পর দেখা হলো। সবাই খুশিতে আত্মহারা। এরই মাঝে কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো আজ রাতে সবাই একসাথে ছাদে বসে আড্ডা দিবে। সময়মতো সবাই উপস্থিত। কোনো একজন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সমবয়সী বোনদের চাপে আসতে রাজি হলো। আর আড্ডার শুরুতেই যখন সবাই একজন আরেকজনের রিলেশনের (প্রেমের) খবর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, তখনই অনিচ্ছা সত্ত্বে আসা বোনটি বিরক্তি আর ঘৃণার সাথে আড্ডার স্থান ত্যাগ করলো। সবাই চোখ দু’টি বড় করে তার প্রস্থান দেখতে থাকলো …।

IIRT Arabic Intensive

বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আসা ছেলে-মেয়েগুলো বন্ধু-বান্ধবী খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেরা খোঁজে মেয়েবন্ধু, আর মেয়েরা খোঁজে ছেলেবন্ধু, যে যার ইচ্ছেমতো খুঁজে নিচ্ছে। দু’মাস শেষ না হতেই কারো একজন, কারো দুইজন, আবার কারো এর চেয়েও বেশি জুটে গেলো। কিন্তু ছ’মাস শেষেও ক্লাসের একটি মেয়ের সাথে কোনো ছেলেবন্ধু দেখা যাচ্ছে না। তাই দু-একজন একটু উদারতার পরিচয় দিতে তাকে সহযোগিতার হাত বাড়ালো। কিন্তু না, সে কিছুতেই ছেলে বন্ধু চাচ্ছে না, এমনকি ক্লাসমেট ছেলেদের সাথে কথা বলতেও তেমন পছন্দ করছে না। তাই কেউ কেউ উপহাস করতে গিয়ে প্রায়ই বলে ‘মনে হয় কোন কোটা খালি নাই।’ আর এরকম কিছু অপবাদ নিয়েই চলতে লাগলো তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন …।

রুমমেট সবারই অনার্স শেষের দিকে, প্রত্যেকেই চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। একজন বিসিএস প্রিপারেশন নিচ্ছে, একজন ব্যাংক জব করতে চাচ্ছে, আরেকজন আমেরিকা যেতে GRE প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু একজন এসবের কোনোটারই প্রস্তুতি নিচ্ছে না। সে সরকারি চাকরিতে ঘুষের সম্ভাবনা দেখে, ব্যাংক চাকরিতে সুদের হিসাব-নিকাশ অপছন্দ করে, আর আমেরিকায় যাওয়াকে এক প্রকার ঘৃণাই করে। তাই সে রুমমেটদের সাথে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো, তার চাকরিজীবনের বেশ কিছু পথও বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু এসব নিয়ে সে কখনোই চিন্তিত নয়, বরং সে তার রিযিক এর বিষয়টি তার পালনকর্তার উপরই সোপর্দ করে রেখেছে …।

পরিবারের বড় ছেলে। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই তার থেকে একটু বেশি আশা করে। সে এবার দেশের নামকরা কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কিছু দিন অতিবাহিত হতেই তার মধ্যে একটা বড় রকমের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সে এখন আর আগের মতো সালাত ছেড়ে দেয় না, তার মোবাইলে কোনো গান-বাজনাও খুঁজে পাওয়া যায় না, আবার তার দাড়িগুলোও যেন দিনদিন বেড়ে চলছে। তাই পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেও সে আলোচনার মূল বিষয়। কেউ বলছে সে কোনো সংগঠনের খপ্পড়ে পড়েছে, কেউ বলছে সে মনে হয় প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে, আবার কেউ বলছে সে আইএস হয়ে গেছে। কিন্তু সে তার রব্ব-কে খুশি করতেই নিজেকে পরিবর্তন করেছে। তাই তার রব্ব এর উপর ভরসা করেই এই প্রতিকূল পরিবেশে তার জীবনযাত্রা …।

উপরের ঘটনা পাঁচটিসহ এরকম শতশত ঘটনা আমাদের জীবনে অহরহ ঘটে চলছে। আর এসব ঘটনায় আমি ও তুমি (রূপক অর্থে) সবার সাথে তাল মিলিয়ে চললেও সে কিন্তু এমনটা করে না। সে নিজের ছোট্ট জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে চিন্তা করে, আর এ জীবনের পরবর্তী জীবনটা কেমন হতে পারে তা নিয়ে আরেকটু বেশি চিন্তা করে। তাই তার জীবনে এমন কিছু ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যা আমাদের ও তার মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিরাট পার্থক্য। আর এই পার্থক্যগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারার মধ্যেও থাকতে পারে আমাদের জন্য কল্যাণকর কিছু। তাই আমাদের সাথে তার গড়ে উঠা পার্থক্যগুলো খুঁজে বের করতে অল্প কিছু কথা। আশা করি সবটুকু পার্থক্য খুঁজে বের করতে না পারলেও কিছুটা পেয়ে যাবো, আর এ পথ ধরেই বাকিটা খুঁজে নিবো। ইন শা আল্লাহ।

পার্থক্যটা যেখানে

– আমি আর তুমি যখন নির্লজ্জের মতো নিজের দৃষ্টি কে কারো দিকে লেলিয়ে দেই, তখন সে আল্লাহর ভয়ে নিজের দৃষ্টিকে হিফাযত করে।
– আমি আর তুমি যখন ক্লাসমেট আর কাজিন বলে একসাথে বসে আড্ডা দেই, তখন সে নন-মাহরাম ভেবে দূরত্ব বজায় রাখে।
– আমি আর তুমি যখন ধনী হওয়ার স্বপ্নে হালাল-হারাম বিবেচনার সময় খুঁজে পাই না, তখন সে হারাম থেকে দূরে থাকতে ধনী হওয়ার স্বপ্নই দেখে না।
– আমি আর তুমি যখন লোকে কী বলবে ভেবে ইসলামকে বিসর্জন দিয়ে দেই, তখন সে ইসলামকে প্র্যক্টিস করতে গিয়ে অনেক কটুকথাই নিয়মিত শুনে যায়।

অর্থাৎ আমার আর তোমার থেকে সে অনেক আলাদা। আর তা যেন আমাদের জীবনের প্রতিটা কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ফুটে উঠছে।

তাহলে কেন এই পার্থক্য? সে কেন আমাদের থেকে আলাদা? আর সে কিসের আশায় এমনটা করছে?

মানুষ স্বভাগতভাবেই যে কোনো কিছুর বিনিময় চায়। বলতে পারো- ‘এমন অনেকেই রয়েছে যারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করে যাচ্ছে।’ তবে এই বলাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়, কোনো কিছুই নিঃস্বার্থ হয় না। কারণ সে মানুষের কাছে কোনো বিনিময় না চাইলেও তার প্রতিপালকের কাছে ঠিকই এর বিনিময় আশা করে। আর যে তার প্রতিপালকের নিকট বিনিময় চায় না, তবে সে অবশ্যই মানুষের নিকট বাহবা আর প্রশংসা পেতে চায় (যা একপ্রকার বিনিময় বটে)। তেমনি পৃথিবীতে আমার আর তোমার চাওয়া-পাওয়ার তুলনায় তার চাওয়া-পাওয়া কম হলেও সে এই ঘাটতি পূরণের অপেক্ষা ঠিকই করছে। সে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত রাখতে এখন কষ্ট স্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে নিজের অন্তরকে প্রশান্ত করার পূর্ণ আশা নিয়মিতই করছে। এককথায় সে পৃথিবীতে যা কিছুই ছাড় দিচ্ছে এসবের পূর্ণ বিনিময় তার প্রতিপালকের নিকট হতে পাবার আশা রাখে, এবং খুবই আশা রাখে।

তাহলে দেখি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক তার জন্য কী ওয়াদা করেছেন-

যে তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল-খুশি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত।’ [সূরা আন নাযিয়াত (৭৯): ৪০-৪১]

তিনি আরো বলেছেন,

‘মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনয়ী পুরুষ ও বিনয়ী নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও সিয়ামপালনকারী নারী, লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী- এদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।’ [সূরা আহযাব (৩৩): ৩৫]

তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, সে যেসবের জন্য অপেক্ষা করছে তা পার্থিব যেকোনো চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে উত্তম। সে পৃথিবীতে যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছে এর বিনিময়ে অনেক বড় পুরষ্কার (জান্নাত) পেতে যাচ্ছে। অথচ আমরা পার্থিব ভোগ-বিলাসিতার পেছনে দৌড়ে ক্লান্ত, আবার এই ক্লান্তি দূর করার সঠিক উপায়ও খুঁজে নিচ্ছি না। তাহলে কি আমরা ভুল পথেই চলছি?

এসো এই ছোট্ট প্রশ্নটি নিজের পরিশ্রান্ত মনকে এখনি জিজ্ঞেস করে দেখি। হয়তো এমন কোনো উত্তর পেয়ে যাবে যা আমাদের জীবনকে বদলে দিবে, আমাদেরকে একটি সহজ-সরল পথের সন্ধান দিবে। যে পথ শেষে থাকবেনা কোনো ক্লান্তি, স্পর্শ করবেনা কোনো হতাশা। আর সবশেষে হাসিমুখে পৌঁঁছে যাবো আপন পালনকর্তার সান্নিধ্যে।

আর বাঁকা পথের সংখ্যা একাধিক হওয়া স্বাভাবিক হলেও সহজ-সরল পথ একটিই হয়। তাই এই সহজ-সরল পথে চলা মানুষের স্বল্পতা যেন আমাদের কখনোই নিরাশ না করে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইসলাম শুরু হয়েছিলো গুরাবা (আগন্তুক/অপরিচিত) হিসেবে, এবং এটা আবার ফিরে যাবে গুরাবা হয়ে। সুতরাং গুরাবাদের (আগন্তুকদের) সুসংবাদ দাও।’ [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমান ২৭০]

আল্লাহ্ আমাদের জন্য সহজ করুন। (আমিন)

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

One Response

Leave a Reply to Md Sohel Rana Cancel Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive