একআব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। মুনাফিকদের সর্দার। বিভিন্ন সময় রাসূল ﷺ কে নিয়ে অশোভন উক্তি সে করেছে। আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে। তার ছেলের নাম ছিলো আব্দুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি ছিলেন খাঁটি মুসলিম। রাসূল ﷺ কে খুব ভালোবাসতেন তিনি। এক যুদ্ধে এসে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বললো, “এবার যুদ্ধ শেষ করে মদিনায় পৌঁছার পর সম্মানিত ব্যক্তি, অপমানিত ব্যক্তিকে মদিনা থেকে বের করে দিবে।”

সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সে নিজেকে বুঝালো আর অপমানিত ব্যক্তি বলতে রাসূল ﷺ কে। এ কথা শুনে নিজের পুত্রই ভয়ানক ক্ষেপে গেলো। পিতাকে জোরে আঁকড়ে ধরে বললো, “আমি আপনাকে মদিনায় যেতেই দিবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি স্বীকার করে নেন যে, আপনি অসম্মানের পাত্র। আর আল্লাহর রাসূল ﷺ সম্মানের।” ছেলের রণমূর্তি থেকে পিতা বাধ্য হলেন স্বীকার করে নিতে।

IIRT Arabic Intensive

আব্দুল্লাহ তাও থামলেন না। রাসূল ﷺ এর কাছে ছুটে গেলেন। বললেন, “আমায় অনুমতি দিন! এই বদ লোকটার গর্দান উড়িয়ে দেই। সে আপনাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করে।”

নিজের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার কথা শুনেও আল্লাহর রাসূল ﷺ রাগ করলেন না। বরং আব্দুল্লাহকে নির্দেশ দিলেন পিতার সাথে সদাচারণ করতে। মমতার স্বরে কথা বলতে।

দুইমুসআব ইবনে উমাইর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। নামটা শুনলেই মনে ভেসে ওঠে মক্কার এক হ্যান্ডসাম যুবকের কথা। যে যুবক আল্লাহর রাসূলকে ভালোবেসে জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। সে সময়কার সবচেয়ে স্টাইলিশ জুতা থাকতো তাঁর পায়ে। তখনকার যুগে ইয়ামেনী জুতা ছিলো সারা বিশ্বে বিখ্যাত। আর তাঁর পায়ে থাকতো ইয়ামেনী জুতার মধ্যেও সবচেয়ে দামী জোড়াটি। আর ইসলামের গ্রহণের পর তাঁর কী অবস্থা হয়েছিলো? ইবনে হিশামের বর্ণনায় বলা আছে, অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্টিতে তাঁর গায়ের চামড়া এমনভাবে উঠে গিয়েছিলো যেমন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে।

বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে একজন বন্দীর নাম ছিলো আবু আজিজ ইবনে উমাইর। এ আবু আজিজ ছিলেন মুসআব ইবনে উমাইরের ভাই। যুদ্ধবন্দী থাকাকালীন সময়কার কথা আবু আজিজ পরে বর্ণনা করেন-

“বন্দী থাকা অবস্থায় আমি একদল আনসারের দায়িত্বে ছিলাম। তারা যখনই খেতে বসছিলো তখনই আমাকেও রুটি এবং খেজুর খেতে দিচ্ছিলো। এ ছিলো রাসূলের ﷺ নির্দেশ পালন, যে নির্দেশে তিনি তাদেরকে আমাদের সাথে ভালো আচরণ করতে বলেছিলেন। আমার ভাই মুসআব একসময় আমার পাশ দিয়ে গেলেন এবং আনসারদের যে ব্যক্তিটি আমার দায়িত্বে ছিলো তাকে বললেন, ‘একে শক্ত করে বাঁধো। এর মা হলেন একজন অত্যন্ত সম্পদশালী মহিলা এবং তিনি এর বিনিময়ে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে সক্ষম।’”

আবু আজিজ যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। খুব অবাক হয়ে মুসআবের দিকে ফিরে তিনি বললেন, “আপনি আমার ভাই আর আমার ব্যাপারে এটা আপনার কেমন নির্দেশ!”

“তিনি হলেন আমার ভাই, তুমি নও।” সাথের আনসার সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন মুসআব।

উহুদ যুদ্ধে যখন মুসআব শুনেছিলেন রাসূল ﷺ বেঁচে নেই, তখনো যুদ্ধ থেকে তিনি দমেননি। যে ভালোবাসা হৃদয় থেকে আসা, তা মৃত্যুতে কেন দমবে? মুসআব বলে উঠলেন, “ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল … আর মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহর একজন রাসূল! তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।”

যেসকল মুসলিম একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, তাঁরা সবাই যেন জেগে উঠলেন। ইতোমধ্যে আরেক মুশরিক সেনা তাঁর বাঁ হাতটি বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। তিনি এবার বাহু দুটির অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা আঁকড়ে ধরে রাখলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন “মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহর একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে” তবুও ইসলামের পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দিলেন না । এমতাবস্থায় ইবনে কামিয়া নামের এক পাপিষ্ঠ এসে একটি তীক্ষ্ণ বর্শা দ্বারা তাঁর দেহে আঘাত করলো। বর্শাটি তাঁর দেহটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললো। এবার মুসলিম বাহিনীর পতাকা মাটিতে পড়ে গেলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যে কথাটি (ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল…মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে) বলে গেছেন, পরবর্তীতে সে কথা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের একটি আয়াত [সূরা আলে ইমরান (৩):১৪৪] হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন এবং পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ কথাটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সংরক্ষিত থাকবে।

তিনবদর যুদ্ধে রাসূল ﷺ এর প্রহরায় ছিলেন আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। খুব মন দিয়ে তিনি এই কাজটি করতেন সবসময়। হঠাৎ খেয়াল করলেন, রাসূল ﷺ এর চাদর মাটির সাথে লেগে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে তিনি চাদরটি ঠিক করে দিলেন। আবার চলে গেলেন শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে।

যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিলেন আবদুর রহমান। তিনি ছিলেন আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর বড় ছেলে। তখনো তিনি মুসলিন হননি। হঠাৎ করেই আবদুর রহমান হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “এমন কোনো মুসলিম আছে, যে আমার সাথে যুদ্ধ করবে?”

আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এ হুংকার শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। তরবারী হাতে যুদ্ধ করতে উদ্যত হলেন। পিতা-পুত্রের এমন যুদ্ধের দৃশ্য রাসূল ﷺ এর পছন্দ হলো না। তিনি আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে নিষেধ করলেন। বললেন, “তুমি আমার কাজেই নিয়োজিত থাকো।”

আবদুর রহমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) পরে মুসলিম হয়েছিলেন। পিতাকে বলেছিলেন, “আব্বা! বদর যুদ্ধে আপনি আমার তরবারীর আওতায় এসে গিয়েছিলেন। ইচ্ছা করেই আপনাকে আঘাত করিনি।” পিতা জবাব দিলেন, “আমি তোমাকে দেখতে পাইনি। দেখতে পেলে আর অন্যদিকে যেতাম না। তোমায় জীবিত ছাড়তাম না।”

ঈমানের পূর্ণতা দাবীর শর্ত হলো আল্লাহর রাসূল ﷺ কে সবচেয়ে ভালোবাসা। নিজের পরিবারের চেয়ে। নিজের জীবনের চেয়ে। আমরা অনেকেই ভাবি, কেন আমরা আজ এতটা নিচে পড়ে আছি? পদে পদে মার খাচ্ছি? অথচ সাহাবারা ছিলেন কতটা উপরে! উত্তরটা তাঁদের জীবনেই লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে আমাদের জীবনেও। তাঁরা সবকিছুর চেয়ে আল্লাহর রাসূলকে ভালোবেসেছিলেন। ইসলামকে অন্তরে ধারণ করেছিলেন। সে ইসলামে কোনো ছাড় ছিলো না। পরিবারের জন্য না, বন্ধুর জন্য না।

ভালোবাসা মানুষভেদে বিভিন্ন রকম হয়। আমরা বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা দেখাই- তার খারাপ সময়ে তাকে ত্যাগ না করে। মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাই- তার উপদেশগুলো মানার চেষ্টা করে। স্ত্রীকে ভালোবাসা দেখাই- তার ভুলগুলোকে ক্ষমা করে। ভালোবেসে তাকে জড়িয়ে ধরি। চুমু খাই।

একইভাবে আল্লাহর রাসূলকে ﷺ ভালোবাসার আলাদা ধরণ আছে। তাঁকে ভালোবাসতে হবে অনুসরণের মাধ্যমে। হুবহু অনুসরণ। তিনি ডানে হেঁটে যেতে বললে আমরা হেঁটেই যাবো। দৌড় দিবো না। অবহেলায় তাঁর সুন্নাহ ছেড়ে দিবো না। আবার ভালোবাসার নামে ধর্মে বিদ’আত সৃষ্টি করবো না। তিনি যেভাবে ইসলামকে বুঝিয়েছিলেন, সেভাবেই বুঝবো। নফলকে ধরে ফরজ ছেড়ে দিব না। ইসলামে শর্টকাট কিছু খুঁজবো না। উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বেশ ভালোমতোই জানতেন একটি পাথরের কোনো ক্ষমতা নেই আমাদের উপকার কিংবা ক্ষতি করার। কিন্তু তারপরেও তিনি একটি পাথরকে (হাজরে আসওয়াদ) চুমু খেতেন, কারণ তিনি রাসূল ﷺ কে ঐ পাথরে চুমু খেতে দেখেছেন।

আমরা তো সুন্নাহর ফাঁক-ফোকর খুঁজে তা ত্যাগ করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকি। সাহাবারা কী করতেন? তাঁরা চাইতেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ এর সুন্নাহকে ধারণ করতে। আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) একদিন রাসূল ﷺ কে তরকারির মধ্যে লাউয়ের টুকরোগুলোকে বেছে বেছে খেতে দেখেছিলেন। ব্যস, এতটুকু দেখেই তিনি নিজের জন্য লাউ পছন্দ করিয়ে নিয়েছিলেন। অথচ না কখনো রাসূল ﷺ তাঁকে লাউ খাবার নির্দেশ দিয়েছেন, না এর কোনো ফযীলত বর্ণনা করেছেন।

ভ্রমণের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে যেতেন এবং দুপুরবেলা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতেন। কারণ, তিনি রাসূল ﷺ কে একই জায়গায় একইভাবে বিশ্রাম নিতে দেখেছেন। একবার ভ্রমণের সময় রাসূল ﷺ প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে এক জায়গায় থেমেছিলেন। সফরে বের হলে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও সে জায়গায় থেমে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতেন। কুররা ইবনে ইয়াস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যখন রাসূল ﷺ এর হাতে বাই’য়াত নিতে এসেছিলেন, তখন তিনি লক্ষ করলেন রাসূল ﷺ এর জামার বোতাম খোলা রয়েছে। এ জন্য শীতে কিংবা গরমে কখনো তিনি জামার বোতাম লাগাতেন না।

সাহাবীরা এভাবেই রাসূল ﷺ কে ভালোবাসতেন। সে ভালোবাসায় কোনো যুক্তি ছিলো না। অজুহাত ছিলো না। এ কারণেই তাঁরা প্রয়োজনে রাসূল ﷺ এর জন্য জীবন দিতে পারতেন। পরিবার আর রাসূল ﷺ মুখোমুখি হলে রাসূল ﷺ কে বেছে নিতে তাঁদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হতো না।

আমরা তো সেদিনই আবার উঁচুতে উঠবো, যেদিন আমরা আল্লাহর রাসূলকে সত্যিই ভালোবাসতে পারবো। আমাদের লেবাসে, চিন্তায়, কথায়, কাজে- সে ভালোবাসা প্রকাশ পাবে।

মুখে ভালোবাসার কথা বলে কাজে অন্যটা করতে চেয়েছিলো মদিনার কিছু লোক।

ইতিহাস তাদের ‘মুনাফিক’ উপাধিতে চেনে।

“বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহ ও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।” [আলি ‘ইমরান (৩):৩১]

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

2 Responses

    • Avatar photo
      শিহাব আহমেদ তুহিন

      ওয়ালাইকুমুস সালাম,

      এটি বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা। আপনি ‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’ ১ম খণ্ডে অনেক গোছানো আর ডিটেইলস পাবেন পুরো গল্পটা।

      Reply

Leave a Reply to শিহাব আহমেদ তুহিন Cancel Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive