মুরাবাহা হচ্ছে ইসলামিক ব্যাংকিং এর বহুল প্রচলিত একটি ফাইনান্সিং মোড। মুরাবাহাতে কোন পণ্য বিক্রির সময় ব্যাংকগুলো ক্যাশ প্রাইস এর চেয়ে ক্রেডিট প্রাইস বেশি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ কোন পণ্য এখন ক্রয় করলে ১০০ টাকায় ক্রয় করা যেত। কিন্তু ক্রেতার কাছে যেহেতু এখন ১০০ টাকা নেই, তাই সে বাকিতে ক্রয় করল, মূল্য পরিশোধ করবে কিছু সময় পরে। বিক্রেতা এখন সময়ের কারণে মূল্য বাড়িয়ে ১২০ টাকা নির্ধারণ করল। এখানে বাড়তি ২০ টাকা আসল সময়ের ফলে। ‘সময়’ এখানে একটা ফ্যাক্টর যা মূল্য বৃদ্ধি করে। এটা কি রিবা? ইসলাম কি টাইম ভ্যালু অব মানিকে সমর্থন করে? এই আর্টিকেল পড়লে ইসলামিক ব্যাংকিং এর এই বিষয়গুলো নিয়ে সংশয় নিরসন হবে ইনশাআল্লাহ।

মুরাবাহা কি?

বাই-মুরাবাহা ব্যবসায়ের একটা মোড। টেকনিক্যালি এটা হচ্ছে ‘খরচ+মুনাফা’ বিক্রয়। বিক্রেতা এখানে পণ্য যেই মূল্যে ক্রয় করেছে তা বলে দেয় এবং বিক্রেতা ও ক্রেতা ‘মুনাফা’ কত হবে তা নির্ধারণ করে। এতে করে যেসব ক্রেতা বাজার সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখে না, তাদের সুবিধা হয়। কারণঃ বিক্রেতাকে পণ্যের ক্রয়মূল্য (খরচ) বলে দিতে হয়।

IIRT Arabic Intensive

ব্যাংক কীভাবে ‘মুরাবাহা’ ব্যবহার করে?

ব্যাংক এটাকে ফাইনান্সিং এর একটা মোড হিসেবে ব্যবহার করে। যা হলো ক্রেডিট মুরাবাহা। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি একটা পণ্য কিনবেন, কিন্তু আপনার কাছে টাকা নাই। আপনি ইসলামিক ব্যাংকে যাবেন। আপনি যেই পণ্যটি কিনতে চান, তার বর্ণনা ব্যাংককে বললেন। ব্যাংক ঐ পণ্যটি ক্রয় করল অন্য কারো থেকে ১০০ টাকা দিয়ে। এবং আপনার কাছে আরো ৫০ টাকা মুনাফায় ১৫০ টাকা বিক্রয় করল। আপনি প্রতি মাসে ১০ টাকা করে আগামি ১৫ মাসে ইন্সটলমেন্টে ১৫০ টাকা পরিশোধ করে দিলেন। অর্থাৎ ব্যাংক আপনার কাছে বাকিতে বিক্রয় করল। এই পদ্ধতিটিকেই বলে ক্রেডিট মুরাবাহা।

সমস্যাটা কোথায়?

আপনি যদি বাকিতে না ক্রয় করে নগদ মূল্যে মার্কেট থেকে পণ্যটি ক্রয় করতেন তবে মূল্য হতো ১২০ টাকা। অর্থাৎ ক্যাশ প্রাইস (নগদ মূল্য) আর ক্রেডিট প্রাইস (বাকিতে মূল্য) এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের কারণ ক্রেতা পণ্যের মূল্য দেরিতে পরিশোধ করছে। অর্থাৎ প্রাইসের বৃদ্ধি = সময়। অনেকেই বলে থাকেন, এটা টাইম ভ্যালু অব মানি তাই রিবা, এটাই সংশয়।

ইসলামিক ব্যাংকিং: মুরাবাহা ও টাইম ভ্যালু অব মানি

একটা বিষয় ক্লিয়ার হওয়া দরকার, তা হলো ইসলাম বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়ে কোন বাধা নিষেধ আরোপ করেনি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধারে পণ্য ক্রয় করেছেন।

‘আয়িশাহ (রাযি.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ইয়াহূদির নিকট হতে নির্দিষ্ট মেয়াদে মূল্য পরিশোধের শর্তে খাদ্য ক্রয় করেন এবং তার নিকট নিজের লোহার বর্ম বন্ধক রাখেন”। (সহিহ বুখারি, তাওহীদ পাবলিকেশন, অধ্যায় ৩৪/ক্রয়-বিক্রয়, হাদীস নং: ২০৬৮)

কোন পণ্যের মূল্য বিভিন্ন কারণে বাড়তে পারে। যেমন- একটা পণ্য চট্টগ্রামে ২০ টাকা, কিন্তু ঢাকায় ৩০ টাকা হতে পারে। এখানে ফ্যাক্টর হচ্ছে ‘স্থান’। আবার ধরুন, একদিন বিকালে কাটাবনে আপনি গেলেন বই কিনতে। মুফতি তাকী উসমানী’র ‘ইসলামিক ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতি’ বইটা আপনার কাছে রাখল ১০০ টাকা। অন্যদিকে আপনার বন্ধু সকালে একই বই কিনেছে ১১০ টাকা দিয়ে। তাহলে এখানে কি ১০ টাকা সুদ হবে? উত্তর – না। ক্রেতা ও বিক্রেতা কোন মূল্যের ওপর একমত হলেই হলো। এখানে ক্রেতা ১০ টাকা বেশি দিচ্ছে কারণ তার বারগেইনিং (Bargaining) পাওয়ার কম। এভাবে বিভিন্ন কারণে মূল্যের তারতম্য হতে পারে, যেমন ধরুন আপনাকে একজন বিক্রেতা ভালো জানে, সে আপনার কাছ থেকে ১০ টাকা কম রাখল। এখানে ফ্যাক্টর হচ্ছে ‘বিক্রেতার সাথে সম্পর্ক’ ইত্যাদি। অর্থাৎ মূল বিষয় হল : ক্রেতা ও বিক্রেতা মূল্যের ওপর একমত হওয়া। আল্লাহ বলেছেন,

“…কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসায় করা হয় তা বৈধ…” (আল কুরআন ৪:২৯)

‘টাইম (সময়)’ কি প্রাইস নির্ধারণে একটা ফ্যাক্টর হতে পারে? উত্তর হচ্ছে: হ্যাঁ, পারে। কিছু বিপরিত মত থাকলেও, চার মাযহাব ও বেশিরভাগ স্কলার এই বিষয়ে একমত।

হানাফি মাযহাব: “দেরিতে পরিশোধের বিনিময়ে মূল্য বাড়তে পারে” [১]

মালিকি মাযহাব: “বেশি সময়ের জন্য কিছু পরিমাণ মূল্যের সাথে যোগ হতে পারে” [২]

শাফি’ঈ মাযহাব: “নগদে পাঁচ দেরিতে পরিশোধে ছয়ের সমান” [৩]

হাম্বলি মাযহাব: “দেরি মূল্যের সাথে কিছু যোগ করে” [৪]

বর্তমান সময়ের শাইখ ইবনে বায (রহিমাহুল্লাহ) ও মুফতি তাকী উসমানী (হাফিজাহুল্লাহ) ক্রেডিট প্রাইস বেশি হতে পারে বলে মত দিয়েছেন। [৫]

এক্ষেত্রে দলিল হচ্ছে, আল্লাহর বাণী, “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন” (আল কুরআন ২:২৭৫) এবং “হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ”। (আল কুরআন ৪:২৯)

আয়াতগুলোর সাধারণ অর্থ হচ্ছে ব্যবসা বৈধ। ক্রেতা বিক্রেতার পরস্পরের সম্মতিক্রমে, ক্রেতা যদি বাকিতে মূল্য পরিশোধের নিমিত্তে বেশি মূল্য দিতে রাজি হয়, তা বৈধ। এক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই সুবিধা পাচ্ছে এবং ‘পরস্পরের সম্মতিক্রমে’ হচ্ছে, কোন জুলুম হচ্ছে না। কারণ জুলুম ‘পরস্পরের সম্মতিক্রমে’ হয়না।

এছাড়া ইসলামে বাই-সালাম বা অগ্রিম বিক্রয় শরীয়ত দ্বারা সমর্থিত।

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করেন তখন লোকেরা এক বা দু’ বছরের বাকিতে [রাবি ইসমাঈল সন্দেহ করে বলেন, দু’ অথবা তিন বছরের (মেয়াদে) খেজুর সলম (পদ্ধতিতে) বেচা-কেনা করত।] এতে তিনি বললেন, যে ব্যক্তি খেজুরে সলম করতে চায় সে যেন নির্দিষ্ট মাপে এবং নির্দিষ্ট ওজনে সলম করে। (সহিহ বুখারি, তাওহীদ পাবলিকেশনঃ ২২৩৯ আধুনিক প্রকাশনীঃ ২০৮০, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ২০৯৭)

স্কলাররা (বাই আস-সালাম) এর উইজডম উল্লেখ করেছেন যে এতে বিক্রেতা তাড়াতাড়ি টাকা পেয়ে যায় এবং ক্রেতা কম মূল্যে পণ্য পায়। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি পরিশোধের জন্য মূল্য কম। এটা (বাই আস-সালাম) নির্দেশ করে যে, পণ্য মূল্যে টাইম একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে কোন সমস্যা নেই। [৬]

কনভেনশনাল ঋণের সাথে এর পার্থক্য কোথায়?

মক্কার কাফেররা এর পার্থক্য বুঝতো না। কারণ তারা টাকা ধার দিলে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর যখন ঋণগ্রহিতা টাকা ফেরত দিতে পারতো না, তখন তারা মূল ঋণের সাথে বাড়তি টাকা যোগ করে দিত এবং পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিত। অর্থাৎ অতিরিক্ত টাকা = অতিরিক্ত সময়। তাই তারা বলতো, “তারা বলে: ক্রয়-বিক্রয়ও তো সুদ নেয়ারই মত!” (আল কোর’আন ২:২৭৫)। স্কলাররা এই আয়াত থেকেও দলিল নিয়েছেন যে, সময় মূল্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাই রিবা ও ব্যাবসায় এর একটা সদৃশ দেখেই কাফেররা বলেছিল, “ক্রয়-বিক্রয়ও তো সুদ নেয়ারই মত!” (আল কোর’আন ২:২৭৫)। কিন্তু আল্লাহ্‌ বলেছেন, “তারা বলে: ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” (আল কোর’আন ২:২৭৫)

পার্থক্য হচ্ছে, ইসলাম মানি কে কনভেনশনাল সিস্টেমের মতো পণ্য হিসেবে দেখে না। তাই কাউকে ঋন দেয়া হলে, সময়ের কারণে ঋনের সাথে কিছু বাড়তি যুক্ত হলে তা সুদ হবে। এখানে সময়ের কারণে ঋনের সাথে বাড়তি যুক্ত হচ্ছে টাকার বা মানি’র ওপর, যা রিবা। অন্যদিকে বাই মুরাবাহাতে সময় একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে, যার কারণে মূল্য বৃদ্ধি ঘটে পণ্যের। ক্রয় বিক্রয় যখন সম্পন্ন হয়, তখন পণ্যের মালিকানা হস্তান্তরিত হয় ক্রেতার নিকট। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা পরস্পরের সম্মতিক্রমে মূল্য ঠিক করবে। একটি মূল্যই ঠিক করবে, এবং ক্রয়-বিক্রয় শেষ হবে। বিক্রেতা যেহেতু মূল্য পরে পাবে তাই এটা এখন রুপ নিবে ঋণে (আদ-দাইন)। অর্থাৎ একবার পণ্যের বিপরীতে মূল্য ঠিক করার পর, এখন তা আদ-দাইন বা ঋন। ঋণ হওয়ার পর বিক্রেতা আর মূল্য বাড়াতে পারবেনা, কারণ তখন তা হবে সময়ের বিপরীতে অতিরিক্ত বৃদ্ধি যা হবে ঋণের বা মানি’র বিপরীতে, যা রিবা।

সারকথা

১। পণ্যের মূল্য নির্ধারণে বিক্রেতা ‘সময়’ কে একটা ফ্যাক্টর ধরতে পারে। এটা রিবা হবেনা। বরং পুরো মূল্যটাই পণ্যের বিপরীতে থাকবে। এটাকে অনেকে বলে পজিটিভ টাইম প্রেফারেন্স।

২। দরদাম এর মাধ্যমে একবার মূল্য ঠিক হলে, পণ্যের মালিকানা ক্রেতার নিকট হস্তান্তরিত হয় এবং ক্রেতা বিক্রেতার কাছে ঋণী হয়। এখন ক্রেতা ঋণগ্রহীতাতে রুপান্তরিত হলো, আর মূল্য হলো ঋণে (আদ-দাইন)। ক্রেতা যদি সঠিক সময়ে মূল্য পরিশোধ করতে না পারে তবে বিক্রেতা/ঋণদাতা এখন আর মূল্য বাড়াতে পারবেনা, বাড়ালে রিবা হবে। অর্থাৎ, একবার মূল্য ঠিক হলে, পরে আর বাড়ানো যাবে না।

৩। ঋণ বা মানি কোন পণ্য নয়। কাউকে কিছু দিনের জন্য টাকা ব্যবহার করতে দিলে, এর ওপর বাড়তি আদায় করা হলেই, তা রিবা হবে, যাকে বলা হয় রিবা আল-নাসিয়া। আল্লাহ্‌ বলেছেন, “…কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে…”। (আল কোর’আন ২:২৭৯) অর্থাৎ ঋণের ক্ষেত্রে মূলধণের অতিরিক্ত রিবা’র অন্তর্ভুক্ত।

 

গ্রন্থ বিবরণী:

১. আইয়ুব, ম. (২০০৭), Understanding Islamic Finance, লন্ডন: জন উইলি এন্ড সন্স

২. উসমানি, ম. ত. (১৯৯৮), An Introduction to Islamic Finance, করাচী

৩. http://www.inceif.org/blog/usury-profit-time-value-money-tvm


[১] বাদা’ই আল-সানা’ই ৫/১৮৭

[২] বিদা’য়াত আল-মুজতাহিদ ২/১০৮

[৩] আল ওয়াযীজ, আল গাজ্জালী ১/৮৫

[৪] ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৯/৪৯৯

[৫] দেখুনঃ শাইখ মুনাজ্জিদ (হাফিজাহুল্লাহ) এর এই ফতোয়াটি এবং মুফতি তাকী উসমানীর ‘An Introduction to Islamic Finance’ বইটি।

[৬] https://islamqa.info/en/13973

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

2 Responses

  1. Mohammad Islam

    কেবল অর্থ ধার দিলে টাইম ভ্যালু অফ মানির কারণে কেন বেশি নেওয়া যাবে না?

    Reply
    • Avatar photo
      মোহাম্মাদ শিবলু

      কারণ তা সুদ হবে। অর্থ ধার দিলে শুধু মূলধন ফেরত নিতে হবে। কোন সুবিধা নেয়া যাবেনা। আল্লাহ্‌ বলেছেন, ” কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে।” (আল কোর’আন ২ঃ২৭৯)। অর্থাৎ মূলধনের অতিরিক্ত যে কোন অর্থই সুদ হবে।

      Reply

Leave a Reply to Mohammad Islam Cancel Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive