আজ নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই ছুটি হয়ে গেলো। অবশ্যি তারও একটা কারণ আছে। নয়তো যে স্যার একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ক্লাসে আসেন, আর এক্সাক্ট টাইমে ক্লাস থেকে বের হয়ে যান – তিনিই কিনা আধাঘণ্টা আগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবেন, তা কি হয়?

কেউ একজন কাগজ পেঁচিয়ে অপরজনকে ঢিল মারতে চেয়েছিলো। কিন্তু ভুলবশত ঢিলটা স্যারের গায়ে লেগেছে। যে ঢিল মেরেছিলো, স্যার তাকে বারবার দাঁড়াতে বলছিলেন – কিন্তু কেউ দাঁড়ায় নি। তাই স্যার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। অনেক রিকুয়েস্ট করেও স্যারকে আর ক্লাসে আনা গেলো না।

IIRT Arabic Intensive

ক্লাশ শেষে আমি আর ফারিস কফি খাচ্ছিলাম কামাল মামার দোকানে। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ এমন সময় রফিক ভাই এলেন। রফিক ভাই আমাদের থেকে দুই ইয়ার সিনিয়র। ইকোনোমিক্সে পড়েন। উচ্চতা পাঁচ ফুট ছ’ ইঞ্চি। গায়ের রঙ কালো। বেশ মোটা। পেটটা একেবারে গামলার মতো। গোঁফ চুলের থেকেও লম্বা। তিনি ভার্সিটির সংস্কৃতি সংঘের সভাপতি। পাশাপাশি একজন নারী অধিকার কর্মী। কথায় আঞ্চলিকতার টান বেশ স্পষ্ট। ইসলামকে খোঁচা দিয়ে কথা বলাটা তাঁর অভ্যাস। ফারিসকে দেখলেই তিনি নানান বিষয়ে প্রশ্ন করেন। অবশ্য জানার জন্য না। পরাজিত করার জন্য। তবে ফারিসকে কখনো পরাজিত করতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।

রফিক ভাই আমাদের দেখে বললেন, “কী রে মোল্লার দল? এইহানে কী করিস?”

ফারিস মুচকি হেসে জবাব দিলো, “কফি খাচ্ছি ভাই। চকলেট ফ্রেভারের কফি। খাবেন?”

“কফি? খাওয়া যায়। তয় শর্ত হইলো তোরা বিল দিতে পারবি না। আমিই দিমু।”

“এ তো মেঘ না চাইতেই জল।”

“অত জল-টল বুঝি না। রাজি থাকলে ক।”

“জ্বী ভাই, রাজি।”

“তাইলে কফি দিতে ক।”

আমি কফির অর্ডার দিলাম। রফিক ভাই লোক সুবিধার না। মনে মনে কী ফন্দি এঁটেছেন কে জানে? তবে যতই ফন্দি করুন না কেন, ফারিসকে পরাস্ত করার শক্তি তাঁর নেই। এর আগেও অনেক কৌশল করেছিলেন ফারিসকে আটকানোর জন্য। কিন্তু পারেননি। ওনার শত জাল ছিন্ন করে ফারিস ঠিকই বেরিয়ে এসেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে কফি চলে এলো। কফির কাপে চুমুক দিয়ে রফিক ভাই বললেন, “আইচ্ছা মোল্লারা এত নারীবিদ্বেষী অয় কেন রে? হেগো সমস্যাডা কোন জায়গায় ক দেহি?”

ফারিস বললো, “ঠিক বুঝলাম না, ভাই।”

“বুঝো না? ফিডার খাও?”

“ভাই, সত্যিই বুঝতে পারছি না। যদি একটু ক্লিয়ার করে বলতেন…”

“মোল্লারা নারী-পুরুষের সমান-সমান অধিকারে বিশ্বাস করে না কেন?”

কথা নেই বার্তা নেই হুট করে কী সব অবান্তর প্রশ্ন। যা ধারণা করেছিলাম তা-ই। আবারো তিনি তর্ক করার জন্যই এসেছেন। ভাব দেখে মনে হচ্ছে এবারকার প্রস্তুতি বেশ জোরালো। ফারিস তাঁর প্রশ্নের জবাবে মুচকি হেসে বললো, “কীভাবে বুঝলেন, ভাই?”

“কেমনে আবার? নারীদের উন্নয়নের জন্য আমরা যা-ই করি না কেন, হেইডাই তাগো গায়ে লাগে। মাইয়াগো সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিলে লাগে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কইরা দিলে লাগে। যৌন স্বাধীনতা দিলে লাগে। যখনই আমরা সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানসমান অধিকারের কথা কই, তহনই তাগো লাগে। বুঝলি?”

“কেন লাগে? তা জানেন কি?”

“কেন আবার? মোল্লারা নারী অধিকারে বিশ্বাস করে না। আর করবেই বা কেমনে? তারা তো আর বিজ্ঞান নিয়া পড়াশুনা করে না। খালি কোরান-হাদিস লইয়া পইড়া থাকে। আর সব কিচ্ছুরে কোরান দিয়া মাপতে চায়। মধ্যযুগের কিতাবের মধ্যে কি আর আধুনিক যুগের সমাধান পাওয়া যায়? যায় না।”

“সবকিছুকে কুরআন-হাদীস দিয়ে যাচাই করাটা কি অন্যায়?”

“অন্যায় না মানে? মারাত্মক অন্যায়। সেই হাজার বছরের আগের কোরান দিয়া কি আমাগো আধুনিক সমাজ মাপলে চলবো? এখন আধুনিক যুগ। বিজ্ঞানের যুগ। তাই সবকিছু বিজ্ঞান দিয়ে মাপতে অইবো। কোরান দিয়া না।”

ইকোনোমিক্সের ছাত্রের বিজ্ঞানের প্রতি এত দরদ – সত্যিই অবাক করার মতো। তবে তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে কতটা জানেন – তা কিন্তু আমি জানি। বেশ ক’মাস সময় নিয়েও ‘বান্ডেল অফ হিস’ কোথায় থাকে তা বলতে পারেননি। আফটার অল বিজ্ঞানমনষ্ক বলে কথা!

ফারিস এবার রফিক ভাইকে বললো, “খুব ভালো লাগলো আপনার কথা শুনে। বিজ্ঞানের প্রতি আপনার যথেষ্ট দরদ আছে দেখছি।”

“থাকবো না কেন? বিজ্ঞান ছাড়া কি চলা যায়? যায় না। তাই বিজ্ঞান জানা আবশ্যক।আর বিজ্ঞানের চর্চা করি বইলাই নারীদের লইয়া ভাবি।সমাজ লইয়া ভাবি। দেশ লইয়া ভাবি।”

“আচ্ছা ভাই, আপনার কাছে ইসলামকে নারী বিদ্বেষী ধর্ম বলে মনে হয়?”

“মনে হইব না কেন? পুরা ইসলামডাই পুরুষগো লাইগা। নারীদের তো ইসলাম দাসী-বান্দী মনে করে।”

“আপনার কাছে কেন এমনটা মনে হয়?”

“কেন অয়, তা তো আগেই কইলাম। ইসলাম মাইয়াগো সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিতে চায় না। খালি বন্দী কইরা রাখবার চায়। ইসলামে পোলারা বেশি অধিকার পায়, আর নারীরা এক্কেবারেই কম। যা পায়, তা না পাওয়ার সমান।”

“আমি যদি বলি ইসলাম সম্পর্কে আপনার ধারণাটা ভুল?”

“ভুল মানে?”

“মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ সমান, এ কথা ইসলাম কখনো অস্বীকার করে না।”

“হা হা হা! তাই নাকি? নতুন শুনলাম মনে অয়।”

“আমাকে কি একটু বলতে দেবেন?”

“দিমুনা ক্যা? ক। কেমনে সমান করছে হেইডা বুঝাইয়া ক?”

“ইসলাম নারী ও পুরুষকে গড়ে সমান ঘোষণা করেছে – সর্বক্ষেত্রে নয়। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ইসলাম নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জকে ফরয করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) আনুগত্যের ব্যাপারে উভয়কেই সমান করা হয়েছে। আমলের ফযীলতের ক্ষেত্রে তাদেরকে সমান ঘোষণা করা হয়েছে। অবাধ্যতার সাজা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তাদেরকে সমান করা হয়েছে। জ্ঞানার্জন উভয়ের উপরে আবশ্যক করা হয়েছে। অনুরূপভাবে, ঈমান ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের মতোই স্বাধীন। উভয়কে মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। উভয়ের জন্য আইনী অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছে।”

“তাই নাকি? মিছা কতা কস ক্যা?”

“মিথ্যা বলবো কেন ভাই? একবারএক লোক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশি হকদার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ লোকটি বললো, ‘তারপর কে?’ নবী (ﷺ) বললেন, ‘তোমার মা।’ সে বললো, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ সে বললো, ‘তারপর কে?’ তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা।’ এই হাদীস আমাদেরকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে, একজন মা তার সন্তানের কাছে পিতার থেকে এক গুণ, দুই গুণ নয় বরং তিনগুন বেশি ভালো ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখে।

“আরেক হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি মেয়েকে বালেগ হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, কিয়ামতের দিন সে এরূপ অবস্থায় আসবে যে, আমি আর সে এ রকমথাকবো।’ এরপর তিনি নিজের আঙ্গুলসমূহ মিলিয়ে দেখালেন। কন্যা সন্তানকে এই হাদীসের মাধ্যমে পুত্র সন্তানের থেকে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেননা দুটি ছেলেকে লালন পালন করলে সে জান্নাতে নবীর (ﷺ) সাথে থাকবে – এমনটা বলা হয়নি। বরং দুটি কন্যার কথা বলা হয়েছে।

“অন্য হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেইসব লোক উত্তম, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম।’ এই হাদীসের মাধ্যমে স্ত্রীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কেননা ইসলামে উত্তম হওয়ার জন্য শুধু আমল নয় বরং স্ত্রীর কাছে উত্তম হওয়াকেও আবশ্যক করা হয়েছে। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হলো, ইসলামে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বলে বিবেচিত হওয়ার মাধ্যম লিঙ্গ নয়।”

“মানে? এত প্যাঁচাস ক্যা। খুইলা ক?”

“বলছি ভাই, বলছি। ইসলামে মর্যাদাবান হওয়ার মাধ্যম নারী বা পুরুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার মধ্যে নিহিত নয়। বরং তাকওয়ার মধ্যে নিহিত। যার তাকওয়া অধিক, সে-ই ইসলামে বেশি সম্মানিত। চাই সে পুরুষ হোক বা নারী। কুরআন কারীমের সূরা হুজুরাতের ১৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন; যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াবান।’ এই আয়াতের মাধ্যমে অধিক মর্যাদাবান হওয়ার জন্য তাকওয়াকে শর্ত বানানো হয়েছে, লিঙ্গকে নয়। হোক সে পুরুষ বা নারী। যার তাকওয়া বেশি, সে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত। তবে ইসলাম নারী ও পুরুষকে কখনোই সব দিক থেকে সমান বিবেচনা করেনি।”

“এটাই তো মেইন সমস্যা। যেইডা আমি তোরে জিগাইতে চাইতেছি। কেন করেনি?”

ফারিস রফিক ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরটা না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা ভাই, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের শারীরিক কাঠামোর মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে?”

“পাগলে কয় কী? হাহাহা! থাকবো না কেন? অবশ্যই আছে। আর আছে বইলাই তো তারা নারী আর আমরা পুরুষ। হা হা হা!”

“তা কয়েকটা বলেন তো শুনি।”

“তাগো শরীর নরম, আমাগো শক্ত। তারা দেখতে আমাদের থেইকা সুন্দর, আমরা কালা। তারা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে, আমরা পারি না। হেগোরে ঋতুস্রাব অয়, আমাগো অয় না। আরও কত পার্থক্য আছে।”

“এগুলো তো নর্মাল পার্থক্য। আভ্যন্তরীণ কী কী পার্থক্যআছে?”

ফারিসের প্রশ্ন শুনে রফিক ভাই মাথা চুলকাচ্ছে। উত্তর দেওয়ার বদলে ইয়ে, মানে করেই শেষ। বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর চর্চাটা এতক্ষণে বেশ ভালোই ফুটে উঠেছে। ইসলাম আর হুজুরদের নিয়ে রফিক ভাইয়ের হেঁয়ালিপনা আমাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছিলো। কিন্তু কিছু বলার মতো সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এবার যেন সেই সুযোগ হলো। ফারিস কিছু বলতে যাবে, এমন সময় আমি তাকে বললাম, “নারী-পুরুষের পার্থক্য গুলো আমি বলি?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়। কেন নয়?” ফারিস জবাব দিলো।

ফারিসের কথা শুনে রফিক ভাই আমার দিকে চোখ বড়-বড় করে তাকালো। আমি সে দিকে তোয়াক্কা না করে বলতে শুরু করলাম,

“আমরা জানি, মস্তিষ্ক হচ্ছে মানবদেহের মূল চালিকাশক্তি। যার দ্বারা পুরো দেহ নিয়ন্ত্রিত হয়। গত ১০ বছরে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পুরুষ ও মহিলাদের মস্তিষ্কে গঠনগত পার্থক্য আছে। আছে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির ভিন্নতা। তাই তাদের উপলব্ধি, কল্পনা, স্বভাব ও পারদর্শিতার ক্ষেত্রগুলোও ভিন্ন। শারীরিক কাঠামোর দিক দিয়ে পুরুষরা অধিক শক্তিশালী। শুধু শক্তিশালীই না, তাদের পেশীশক্তিও বেশি। সাধারণভাবে পুরুষদের মস্তিষ্কের ওজন মহিলাদের তুলনায় ১০০ গ্রাম এবং মস্তিষ্কের কোষকলার সংখ্যা ৪% বেশি। মহিলাদের বিপাকীয় পদ্ধতি পুরুষদের তুলনায় শ্লথ। তবে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন মহিলাদের কিছুটা বেশি।

“মহিলাদের ফুসফুস অপেক্ষাকৃত ছোট। পুরুষের ফুসফুস নারীর তুলনায় বেশি পরিমাণে বাতাস ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু কিডনি, পাকস্থলী, যকৃৎপুরুষদের তুলনায় বড়। সন্তান জন্মদান, স্তন্যদান ইত্যাদি কারণে হরমোন-সংক্রান্ত কার্যকারিতার ব্যাপকতা মহিলাদের বেশি। ক্রোমোজমাল গাঠনিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে মহিলাদের জীবনীশক্তি বেশি এবং সাধারণভাবে তারা পুরুষদের তুলনায় বেশি দিন বাঁচে। মহিলাদের মস্তিষ্কের ডান ও বাম অংশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কাজে ব্যবহৃত কোষকলার সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি।

“শরীরবৃত্তীয় কারণেই পুরুষ ও মহিলাদের অনুভূতির ক্ষেত্রেও পার্থক্য বিদ্যমান। পুরুষদের মধ্যকরোটিগত লোব যা গণনা সংক্রান্ত কার্য সম্পাদন করে থাকে, তা অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় তারা সাধারণভাবে অংক, জ্যামিতি ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়। স্থান সম্পর্কিত ধারণা বেশি থাকায় তারা অনেকটা সহজে মানচিত্রের ভাষা বুঝতে পারে। মহিলাদের ‘লিমবিক সিস্টেম’ বা অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত অংশ গভীর ও বিস্তৃত হওয়ায় তারা আবেগ ও অনুভূতি বিশ্লেষণে, বিস্তৃত মাত্রায় তথ্য সংগ্রহে, তথ্যগুলোর মধ্যে পারম্পরিক সম্পর্ক চিহ্নিত ও যোগাযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে অধিক পারদর্শী। সাধারণভাবে বলা যায়, পুরুষরা পদার্থবিদ্যা এবং গণিতে পারদর্শী; আর মহিলারা ভাষা জ্ঞানে ও আবেগ-অনুভূতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে পারদর্শী।”

আমার কথা শেষ হলে ফারিস বললো, “শুধু শারীরিক দিক থেকেই নয়, বরং মানসিক দিক থেকেও নারীরা পুরুষদের থেকে ভিন্ন।”

“তাই নাকি?” রফিক ভাই অবাক হয়ে বললেন।

“হুম। তাই। নারীর আবেগ-উচ্ছ্বাস পুরুষের তুলনায় অধিকতর উথলে ওঠে। নারী পুরুষের তুলনায় দ্রুত অস্থির হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, পছন্দনীয় বিষয়ে ও ভয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত আবেগানুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর তুলনায় অধিকতর ঠাণ্ডা মেজাজের পরিচয় দেয়। নারী স্বাভাবিকভাবেই সৌন্দর্যচর্চা, অলঙ্কারাদি, সাজগোজ ও বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন পছন্দ করে। নারীর আবেগ-উচ্ছ্বাস পুরুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ী হয়। নারী পুরুষের তুলনায় অধিকতর সতর্ক ও ধার্মিক হয়। তারা বেশি কথা বলে। বেশি ভয় পায়। আনুষ্ঠানিকতার অধিকতর পক্ষপাতী।

“ভাষা জ্ঞান, বিশেষ করে ব্যাকরণ, বানান, বাক্যগঠন ইত্যাদিতে তারা বেশি পারদর্শী। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা মানুষের সাথে কাজ করতে বেশি আগ্রহ পোষণ করে। আর পুরুষরা যন্ত্রের সাথে কাজ করতে বেশি পছন্দ করে। শুধু তা-ই নয়, নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি আবেগতাড়িত হয়। ঋতুকালীন সময়ে নারীদের স্নায়বিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। হজম শক্তি কমে যায়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কাজের একাগ্রতা ও মানসিক শ্রমশক্তি কমে যায়।  আর সন্তান প্রসবকালীন সময়ে তারা মানসিক চাঞ্চল্যে ভোগে। তাদের অনুভূতি শক্তি কমে যায়। আর একেবারে শেষ দিকটায় এসে তাদের কর্মক্ষমতা পুরুপুরি কমে যায়। আরও মজার বিষয় কী জানেন, ভাই? নারী ও পুরুষের এই পার্থক্যটা তাদের শিশুকাল থেকেই শুরু হয়।”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ, ভাই। সত্যিই। জন্মের সময় থেকেই দুটি লিঙ্গের পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছেলে শিশু যখন সম্মুখে ঘূর্ণায়মান কোনো বস্তু দেখেই অনেকটা শান্ত হয়ে থাকে, মেয়ে শিশু তখন অন্য কোনো মানুষের মুখ দেখে খুশি হয়। মেয়ে শিশুদের স্নিগ্ধ কথা, বাগান দিয়ে সহজেই ভুলিয়ে ফেলা যায়। ভাষা পুরোপুরি বোঝার আগেই ভাষার অন্তর্নিহিত আবেগ তারা অনুধাবন করতে পারে। মেয়ে শিশুরা ছেলেশিশুদের তুলনায় আগে কথা বলতে শেখে এবং স্কুলে ভর্তির বয়স হওয়ার আগেই অনেকটা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে। আচ্ছা, রফিকভাই, আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী কি নারী-পুরুষ ভিন্ন নয়?”

“হ, অবশ্যই ভিন্ন।”

“সত্যিই?”

“মিছা অইব কেন? এইডা তো বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত বিষয়। স্বীকার না কইরা উপায় আছে?”

“তাহলে এখন বলুন, ইসলাম কীভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চলতে পারে?”

“মানে? তুই কী বুঝাইবার চাস?”

“আধুনিক বিজ্ঞান যেখানে নারী-পুরুষকে সকল ক্ষেত্রে সমান হিসেবে ঘোষণা করেনি, সেখানে ইসলাম কীভাবে নারী-পুরুষকে সকল ক্ষেত্রে সমান হিসেবে বিবেচনা করতে পারে?”

“ভালোই তো পাকনামি শিখছস দেখা যায়।বিজ্ঞান তো নারী-পুরুষের দৈহিক পার্থক্যের কথা কইছে। কাজের পার্থক্যের কথা না। ইসলাম তো কাজেরও পার্থক্যের কথা কয়।”

“দৈহিক পার্থক্যের দ্বারা কি কর্মের পার্থক্য হয় না?”

রফিক ভাই ফারিসের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। কেননা দৈহিক পার্থক্যের কারণে কর্মের পার্থক্য ঘটবে এটা সর্বজন স্বীকৃত বিষয়। এতে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা গাঠনিক পার্থক্যই বলে দিচ্ছে, পুরুষ ও নারীর কর্মক্ষমতা এক নয় – ভিন্ন। নারীরা যেসব কর্মে পারদর্শী, পুরুষরা তার ভিন্ন কর্মে পারদর্শী। নারীরা যেসব জিনিসে আনন্দলাভ করে, পুরুষরা তার ব্যতিক্রম জিনিসে আনন্দলাভ করে। নারীরা যেসব কর্মে পারদর্শী, পুরুষরা তার ভিন্ন কর্মে পারদর্শী। তাহলে প্রত্যেককে তাদের স্বভাবসুলভ কাজে নিয়োগ করাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? রফিক ভাইয়ের মতো লোকেরা যত তাড়াতাড়ি এই সত্যটা অনুধাবন করতে পারবেন, ততই মঙ্গল। নয়তো সমান অধিকারের কথা বলে, নারীকে মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করাটা বিপদজন বৈ কি!

ফারিস এরপর রফিক ভাইকে বললো, “আচ্ছা ভাই, মনে করুন ভার্সিটির কোনো সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের সকল দায়িত্ব আপনার কাঁধে। এখন সে প্রোগ্রামে গান গাওয়ার জন্য আপনি কাকে নির্বাচন করবেন? যার গলা সব থেকে কর্কশ, নিশ্চয়ই তাকে?”

“না। কক্ষনো না। যে ভালো গান গাইবার পারে হেরে নির্বাচন করুম।” রফিক ভাইয়ের তাৎক্ষণিক জবাব।

“নাচার জন্য কাকে বেছে নেবেন? যে ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারে, তাকে?”

“নাচার জন্য যে ভালো কবিতা আবৃত্তি করে তারে দিয়া কী করমু? হা হা হা! যে ভালো নাচ জানে, হেরে বাইছা নিমু।”

“অভিনয় করতে কাকে নেবেন? যে ভালো কবিতা লিখতে পারে, তাকে?”

“হা হা হা! তোর কি মাথা খারাপ অইছে নি? অভিনয়ের লাইগগা কবি কেন? আমি ভালো অভিনেতা বাইচ্চা নিমু।”

“তাহলে কিছুটা বৈষম্য হয়ে গেলো না?”

“বৈষম্য মানে? এইহানে তুই বৈষম্যের কী দেখলি? আমি তো সবার যোগ্যতা অনুসারেই লোক বাইচ্ছা নিলাম। যে যেইডা ভালো পারে, হেরে হেই কামেই লাগাইলাম।এইহানে বৈষম্য আইলো কোত্থেইকা?”

“আপনি বলতে চাচ্ছেন যার যার যোগ্যতা অনুসারে দায়িত্ব প্রদান করাটাই যৌক্তিক?”

“হ, হ।অবশ্যই।”

“তাহলে ইসলামও যদি নারী-পুরুষের সহজাত স্বভাব ও সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করে, তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

রফিক ভাই মনে হয় তাঁর পাতা ফাঁদেই পা দিয়েছেন। তাই আর কিছু না বলে চুপ করে আছেন। কেননা ইসলাম নারী-পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই তাদের কাজের ক্ষেত্রগুলো আলাদা করে দিয়েছে। নারীকে এমন কোনো কাজে বাধ্য করেনি, যা তাদের জন্য অমানবিক। আবার পুরুষকেও এমন কাজে বাধ্য করে নি, যা তাদের জন্য দুঃসাধ্য।

ফারিস বললো, “আচ্ছা রফিক ভাই, যদি গ্যারেজে অথবা অট্টালিকা নির্মাণ, ক্রেন চালানো কিংবা রাস্তা-ঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে রোলার চালানোর কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করে; আর বাচ্চা লালন-পালন, কাপড়-চোপড় ধোয়া, রান্না-বান্নার কাজে পুরুষরা অংশ নেয়, তাহলে কেমন হবে?”

ফারিসের কথা শুনে আমি হাসতে লাগলাম। এইটাও কি কেউ করবে? ভাবতেই কেমন বিদখুটে লাগছে। নারীরা বাইরে, আর পুরুষরা ঘরে! হা হা হা।

ফারিস আরও বললো, “নারীকে যদি শক্ত কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে দেওয়া হয়, তাহলে তার ফিজিক্যাল প্রবলেম হবে।”

“তাই নাকি?” রফিক ভাই জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ, ভাই। এর ফলে নারীদের দেহের পেশীকলাগুলো পুরুষদের মত শক্ত হয়ে যাবে। তাদের ত্বকের লাবণ্য, দেহের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে, গর্ভধারণে সমস্যা হবে।”

“তাইলে তুই কইতে চাস, নারীরা কোনো চাকরি-টাকরি করতে পারবো না? কেবল ঘরে বইয়া থাকবো? আর বাচ্চা পালবো?”

“আমি কখন সেটা বললাম?”

“তোর কথা শুইনা তো হেইডাই বুঝা যায়।”

“না,ভাই। আপনার সে ধারণা করার সুযোগ নেই।”

“কেন?”

“কারণ, কুরআন কারীমের সূরা মুলকের ১৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘অতএব, তোমরা তাঁর পথেঘাটে বিচরণ কর এবং তাঁর দেঅয়া রিযিক আহার কর।’ এই আয়াত উল্লেখ করে ড. মুহাম্মাদ আল আরিফি (হাফি.) বলেছেন, এই আয়াতের মাধ্যমে উভয়কেই জীবিকা অন্বেষণের জন্য চেষ্টা-তদবীর করতে বলা হয়েছে। শুধু ঘরে বসে থাকতে বলা হয়নি। তবে নারীরা সে কাজগুলোই করবে, যা তাদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল।”

“আরে চাইলে নারীরা সবই করতে পারে। তারা পারে না এমন কোনো কাম নাই।”

“না,ভাই। আপনার ধারণা ভুল।”

“ভুল?”

“জ্বি, ভাই। ভুল।”

“কেন?”

“কারণ নারী ও পুরুষের চিন্তন জগত থেকে শুরু করে সবটাই আলাদা।”

“তোরে কেডায় কইছে?”

“ভাই, এটা মনোবিজ্ঞানীদের কথা। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর রিক্ নারী পুরুষের পার্থক্য সম্পর্কে বলেন, ‘নারী ও পুরুষ তাদের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের দাবি অনুযায়ী পৃথকভাবে ক্রিয়া করে এবং ঠিক দু’টি ভিন্ন অক্ষে অবস্থিত দু’টিভিন্ন নক্ষত্রের ন্যায় পথ চলে। তারা পরস্পরকে বুঝতে পারে এবং পরস্পরের পরিপূরক হতে সক্ষম। কিন্তু তারা কখনো এক বা অভিন্ন হয় না। এ কারণেই নারী ও পুরুষ একত্রে জীবন যাপন করতে পারে, পরস্পরকে ভালবাসতে পারে এবং পরস্পরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী থেকে ক্লান্ত ও অসন্তুষ্ট হয় না।’

“উইল ডুর‌্যান্ট তাঁর লেখা The Pleasures of Philosophy নামক গ্রন্থে লৈঙ্গিক ও পারিবারিক বিষয়াদি সম্বন্ধে অত্যন্ত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নারীর সতীত্ব তার সন্তান জন্মদানের লক্ষ্যের সেবায় নিয়োজিত। কারণ নিজেকে আড়াল বা আবৃত করে রাখার যে কায়দায় সে নিজেকে বিরত রাখে, তা তাকে বিপরীত লিঙ্গের সাথী বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। সতীত্ব নারীকে স্বীয় প্রেমিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কাকে সে স্বীয় সন্তানদের পিতৃত্বের গৌরব প্রদান করবে, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকতর সক্ষম করে তোলে। সমষ্টির ও মানবজাতির স্বার্থ নারীর মুখে কথা বলে, ঠিক যেভাবে ব্যক্তির স্বার্থ পুরুষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে। … বস্তুত প্রেমের খেলায় নারী পুরুষের তুলনায় অধিকতর সুদক্ষ। কারণ, তার আগ্রহ এতটা তীব্র নয় যে, তার বিচারবুদ্ধির চোখকে বন্ধ করে দেবে।’

“ইসলাম মনে করে নারী-পুরুষ মানবজাতিরই দুইটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজ কিংবা সভ্যতা বিনির্মাণে উভয়ের অংশগ্রহণ দরকার। তাই পুরুষের ন্যায় নারীকেও তার যোগ্যতা অনুসারে যতদূর সম্ভব উন্নত হতে ইসলাম কখনোই বাধা দেয় না। বরং উৎসাহিত করে।পাশাপাশি ইসলাম তাকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রদান করে।”

“অর্থনৈতিক অধিকার! এই অধিকারডা কেবল লোক দেহানো।”

“কেন ভাই? লোক দেখানো কেন?”

“কারণ, মাইয়্যাগো দেয় পুরুষদের থেইকা অর্ধেক। এইডা কি অভিনয় ছাড়া আর কিছু? যদি সমান-সমান দিতো, তাইলে না বুঝতাম ঠিক আছে।”

“ইসলাম পুরুষকে পৌত্রিক সম্পত্তিতে নারীর থেকে দ্বিগুণ দিয়েছে। কিন্তু কেন দিয়েছে, তা কি জানেন?”

“কেন? কেন দিছে?”

“ইসলাম পুরুষকে যতটা সম্পত্তি না দিয়েছে, তার থেকে বেশি দায়িত্ব দিয়েছে। পুরুষকে তার পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করাকে আবশ্যক করেছে। কিন্তু নারীকে করেনি। একজন নারী যখন কন্যা– তখন তার সমস্ত দায়িত্ব পিতার উপর। একজ নারী যখন স্ত্রী– তখন তার সব দায়িত্ব স্বামীর উপর। একজন নারী যখন মা– তখন তার সব দায়িত্ব পুত্রের উপর।”

“তাতে কী অইছে?”

“বলছি। ধরুন, আপনার পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ তিন লক্ষ টাকা। তো ইসলামী বিধান অনুসারে আপনি পাবেন দুই লক্ষ টাকা, আর আপনার বোন পাবে এক লক্ষ টাকা। পিতার মৃত্যুর পর ইসলাম অনুসারে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব আপনার উপর বর্তাবে। আপনার বোনের উপর নয়। পরিবারের সমস্ত খরচ আপনাকে বহন করতে হবে। আপনার বোনকে নয়। বোনের বিয়েতে আপনাকেই যথাসাধ্য খরচ করতে হবে। মাকে দেখাশুনা করতে হবে। আবার নিজের বিয়ের খরচের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে। এখন বলুন, এত দায়িত্ব পালন করার পর আপনার কাছে কত টাকা থাকবে? আর আপনার বোনের কাছে কত থাকবে?”

“আমার কাছে তো কোনো টেহাই থাকবো না! বরঞ্চ চাকরি না থাকলে আরও কয়েক লক্ষ টেহা ধার করন লাগবো। আর বৈনের কাছে তো সব টেহাই জমা থাকবো। হের তো কোনো খরচ নাই।”

“আল্টিমেটলি কে লাভবান হচ্ছে?”

“আমার বৈন।”

“তাহলে তো ইসলামের বণ্টননীতি নিয়ে আপনার সমস্যা থাকার কথা নয়।”

ফারিসের দেওয়া ইসলামের সুষম বণ্টননীতির ব্যাখ্যা শুনে রফিক ভাইয়ের মুখটা যেন কালো হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও নিজের কালো মুখটা তিনি আড়াল করতে পারলেন না। ইসলাম নারীকে কখনোই ঠকায়নি। বরং নারীকে মর্যাদার উচ্চাসনে আসীন করেছে। পাশাপাশি তার সহজাত বৈশিষ্ট্যের বাইরে কোনো দায়িত্ব প্রদান করেনি। স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নারী ও পুরুষের এক নয় – ভিন্ন। আমরা সবাই জানি, নারীরা সহজাতভাবেই গর্ভে সন্তান ধারণ করে, যা পুরুষরা করে না। আগত সন্তানের জন্য কার স্তনে দুধ আসে? মাতার। আর এই মায়ের দুধের মধ্যে এমন কিছু পুষ্টি উপাদান থাকে, যা দুনিয়ার আর কোনো দুধের মধ্যে নেই। বাচ্চার বেড়ে উঠার জন্য, মানসিক বিকাশের জন্যে এই শাল দুধ একান্ত জরুরী। সৃষ্টিগতভাবেই কেবল নারীরা বাচ্চার জন্য এই শাল দুধ উৎপন্ন করতে পারে। বাচ্চা জন্মের পর মায়ের অন্তরে বাবার চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এই ভালোবাসা কোনো কৃত্রিম পদ্ধতির মাধ্যমে মায়ের অন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়? যায় না। একজন মা সৃষ্টিগতভাবেই তা অর্জন করেন। তাহলে একজন মা হিসেবে আগত সন্তানের প্রতি মাতার ভূমিকা যা হবে, পিতার ভূমিকা অবশ্যই তার ব্যতিক্রম হবে। আপনি যদি দুজনকে সমান করতে চান, তাহলে কি সেটা বোকামী নয়? দুজনকে দুজনের অবস্থান থেকে সমান করুন। দুজনকে একই অবস্থানে এনে সমান করতে যাবেন না। তাহলে ভয়ঙ্কর বিপত্তি ঘটবে।আমি মনে মনে এ কথাগুলো চিন্তা করছিলাম।

এমন সময় ফারিস বললো, “রফিক ভাই, আসল কথা কী জানেন? ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মিলেই কিন্তু এই বিশাল মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে। আপনি যদি জমিতে লাঙ্গল চালাতে চান , তাহলে অবশ্যই জমিকে লাঙ্গলের চেয়ে নমনীয় হতে হবে। নয়ত ফসল ফলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। আবার একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি রাসায়নিক যৌগও যদি গঠন করতে চান, তাহলে সেখানেও কাউকে দাতা হতে হবে। আর কাউকে গ্রহীতা। কেউ ইলেকট্রন দান করে পজেটিভ আয়ন হবে। আর কেউ সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে নেগেটিভ আয়ন হবে। তারপর এই দুইটা আয়ন মিলে একটি স্থিতিশীল যৌগ গঠন করবে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ছাড়া এ মহাবিশ্ব অচল। তাই কাউকে না কাউকে অবশ্যই ক্রিয়া করার যোগ্যতা থাকতে হবে। আর কাউকে সে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হবে। এটাই স্রষ্টার নিয়ম। আর আপনাদের ভাষায়–প্রকৃতির নিয়ম। কখনো নারী ক্রিয়া করবে, আর পুরুষ সে ক্রিয়া গ্রহণ করবে। আবার কখনো পুরুষ ক্রিয়া করবে, আর নারী সে ক্রিয়া গ্রহণ করবে। এভাবেই মহাবিশ্ব টিকে থাকবে। দুজনকে সবসময় সমান করতে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেননা প্রকৃতিই নারী-পুরুষকে আলাদা আলাদা চিন্তা-চেতনা ও স্বভাব-চরিত্র দান করেছে। আর প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ মানে, পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া।”

এই রফিক ভাইয়ের মতো যারা নারী অধিকার কর্মী, তারাও কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে নারী-পুরুষের পার্থক্য স্বীকার করে নিয়েছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, আন্তর্জাতিক কিংবা দেশীয় বিভিন্ন খেলাধুলায় নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা টিম থাকে। যদি নারী-পুরুষ সব ক্ষেত্রে সমানই হবে, তাহলে তাদের জন্য আলাদা আলাদা টিম করার মানে কি? তাদেরকে একীভূত করে টিম বানানোর দরকার। অন্তত আমাদের ভার্সিটিতে এই কাজটা চালু করা দরকার। যে ভার্সিটিতে রফিক ভাইয়ের মতো লোক আছে, সে ভার্সিটিতে এত বড় বিভাজন কীভাবে মেনে নেয়া যায়? মনে মনে ভাবছিলাম এ প্রস্তাবটা রফিক ভাইকে দেওয়া যায় কি না। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “অহহো। জরুরী একটা কাজ আছে রে। ভুইলাই গেছিলাম। আজ যাই। আরেকদিন কথা অইবো। ভালো থাক।”

এই বলে কফির বিল দিয়ে তিনি দ্রুত প্রস্থান করলেন।

রফিক ভাইয়ের পরাজয় বরণ করে দ্রুত চলে যাওয়ার দৃশ্যটা সেদিন বেশ উপভোগ করেছিলাম। চলে যাওয়ার সময় বেচারা একবারও পেছন ফিরে তাকাননি। আসলে সত্যের মোকাবেলায় মিথ্যা অনুমান আর কতক্ষণই বা টিকতে পারে?

মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন, “তারা শুধু অনুমানের অনুসরণ করে; সত্যের মোকাবেলায় অনুমানের কোনো মূল্য নেই।” [সূরা আন-নাজম (৫৩): ২৮]

তথ্যসুত্র ও গ্রন্থাবলী

■ সূরা আন-নাজমঃ ২৮আয়াত।

■ সূরা মুলকঃ ১৫ আয়াত।

■ সূরা হুজুরাতঃ ১৩ আয়াত।

■ বুখারী, মুহাম্মাদইবনু ইসমাঈল, আস-সহিহ, অধ্যায়ঃআচার ব্যবহার অধ্যায়, পরিচ্ছেদঃ (২৪৩৪), উত্তম ব্যবহার পাওয়ার কে বেশী হকদার? , ৯/৫৫৪৬।

■ বুখারী, মুহাম্মাদইবনু ইসমাঈল,আল-আদাবুল মুফরাত, হাদিস নংঃ ৩,৫,৬।

■ নাবাবী, মুহিউদ্দীন ইয়াহহিয়া ইবনু আশরাফ, রিয়াদুস সালিহীন, অনুচ্ছেদঃ ইয়াতীম,কন্যা, …….. বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করা , ১/ ২৭২, হাদিসটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন ।

■ নাবাবী, মুহিউদ্দীন ইয়াহহিয়া ইবনু আশরাফ, রিয়াদুস সালিহীন, অনুচ্ছেদঃ নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, ১/ ২৮৩, হাদিসটি ইমাম তিরমিযি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ হাদিস হাসান সহীহ, শাইখ আলবানীও সমর্থন করেছেন।

■ আলবানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন, আদাবুয যিফাক, পৃষ্ঠাঃ ১৫৮।

■ ড. মুহাম্মাদ আল আরেফী, ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে, পৃষ্ঠাঃ ৩০; (হুদহুদ পাবলিকেশন, বাংলাবাজার, ঢাকা, নভেম্বর, ২০১৫)

■ William F. Gangong, Medical Physiology (Mc Graw Hil, New York, 21th ed.)

■ CV Rao, a Text Book of Immunology, (Narosa Publishing House, New Delhi, 4th ed.)

■ Ogden et al (2004). Mean Body Weight, Height,and Body Mass Index, United States 1960–2002 Advance Data from Vital and Health Statistics, Number 347, October 27, 2004. http://www.cdc.gov/nchs/data/ad/ad347.pdf, Bren, Linda (July–August 2005).

■ “Does Sex Make a Difference?”.FDA Consumer magazine. Archived from the original on March 26, 2009

https://web.archive.org/web/20090326023753/http://www.fda.gov/fdac/features/2005/405_sex.html

■ Wikipedia, Article: Sex difference in human physiology, https://en.wikipedia.org/wiki/Sex_differences_in_human_physiology

■ Wikipedia, Article: Sex and psychology, https://en.wikipedia.org/wiki/Sex_and_psychology

■ Wikipedia, Article: Sex difference in sensory system, https://en.wikipedia.org/wiki/Sex_Differences_in_Sensory_Systems

■ Wikipedia, Article: Body fat percentage, https://en.wikipedia.org/wiki/Body_fat_percentage

■ https://www.psychologytoday.com/blog/hide-and-seek/201207/the-battle-the-sexes

■ http://findarticles.com/p/articles/mi_g2699/is_0006/ai_2699000616

■ https://www.reference.com/science/males-physically-stronger-females-c2792a4225417356#full-answer

https://www.quora.com/Are-men-generally-physically-stronger-than-women

■ https://www.reddit.com/r/dataisbeautiful/comments/4vcxd0/almost_all_men_are_stronger_than_almost_all_women

 http://www.unz.com/gnxp/men-are-stronger-than-women-on-average

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive