পর্ব ০১ |  পর্ব ০২ | পর্ব ০৩ | পর্ব ০৪

সাজিদের কাছে একটি মেইল এসেছে সকালবেলা। মেইলটি পাঠিয়েছে তার নাস্তিক বন্ধু বিপ্লব ধর। বিপ্লব দা’কে আমিও চিনি। সদা হাস্যোজ্জ্বোল এই লোকটার সাথে মাঝে মাঝেই টি.এস.সিতে দেখা হতো। দেখা হলেই উনি একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুই কি এখনো রাতের বেলা ভূত দেখিস?’

IIRT Arabic Intensive

বিপ্লব দা মনে হয় হাসিটি প্রস্তুত করেই রাখতো। দেখা হওয়া মাত্রই প্রদর্শন। বিপ্লব দা’কে চিনতাম সাজিদের মাধ্যমে। সাজিদ আর বিপ্লব দা একই ডিপার্টমেন্টের। বিপ্লব দা সাজিদের চেয়ে দু’ ব্যাচ সিনিয়র।

সাজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যে প্রথমে নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলো, তার পুরো ক্রেডিটটাই বিপ্লব দা’র। বিপ্লব দা তাকে বিভিন্ন নাস্তিক, এ্যাগনোষ্টিকদের বই-টই পড়িয়ে নাস্তিক বানিয়ে ফেলেছিলো। সাজিদ এখন আর নাস্তিক নেই।

আমি ক্লাস শেষে রুমে ঢুকে দেখলাম সাজিদ বরাবরের মতোই কম্পিউটার গুঁতাচ্ছে। আমাকে দেখামাত্রই বললো, ‘তোর দাওয়াত আছে।’

– ‘কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সাজিদ বললো, ‘বিপ্লব দা দেখা করতে বলেছেন।’

আমার সাথে উনার কোন লেনদেন নেই। আমাকে এভাবে দেখা করতে বলার হেতু কী বুঝলাম না। সাজিদ বললো, ‘ঘাবড়ে গেলি নাকি? তোকে একা না, সাথে আমাকেও।’

এই বলে সাজিদ বিপ্লব দা’র মেইলটি ওপেন করে দেখালো। মেইলটি হুবহু এরকম-

‘সাজিদ,
আমি তোমাকে একজন প্রগতিশীল, উদারমনসম্পন্ন, মুক্তমনা ভাবতাম। পড়াশুনা করে তুমি কথিত ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তুমি যে আবার সেই অন্ধ বিশ্বাসের জগতে ফিরে যাবে- সেটা কল্পনাও করিনি আমি। আজ বিকেলে বাসায় এসো। তোমার সাথে আলাপ আছে।’

আমরা খাওয়া-দাওয়া করে, দুপুরের নামাজ পড়ে বিপ্লব দা’র সাথে দেখা করার জন্য বের হলাম। বিপ্লব দা আগে থাকতেন বনানী, এখন থাকেন কাঁটাবন। জ্যাম-ট্যাম কাটিয়ে আমরা যখন বিপ্লব দা’র বাসায় পৌঁছি, তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। বিপ্লব দা’র সাথে হ্যান্ডশেক করে আমরা বসলাম না। সাজিদ বললো,- ‘দাদা, আলাপ একটু পরে হবে। আসরের নামাজটা পড়ে আসি আগে।’
বিপ্লব দা না করলেন না। আমরা বেরিয়ে গেলাম। পার্শ্ববর্তী মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে ব্যাক করলাম উনার বাসায়।

বিপ্লব দা ইতোমধ্যেই কফি তৈরি করে রেখেছেন। খুবই উন্নতমানের কফি। কফির গন্ধটা পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই।
সাজিদ কফি হাতে নিতে নিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘জানিস,  বিপ্লব দা’র এই কফি বিশ্ববিখ্যাত। ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি। এইটা কানাডা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। বিপ্লব দা কানাডা থেকে অর্ডার করিয়ে আনেন।’

কফির কাপে চুমুক দিয়ে মনে হলো আসলেই সত্যি। এত ভালো কফি হতে পারে-ভাবাই যায় না।

সাজিদ এবার বিপ্লব দা’র দিকে তাকিয়ে বললো,- ‘আলাপ শুরু হোক।’

বিপ্লব দা’র মুখে সদা হাস্যোজ্জ্বল ভাবটা আজকে নেই। উনার পরম শিষ্যের এরকম অধঃপতনে সম্ভবত উনার মন কিছুটা বিষণ্ণ। তিনি বললেন, ‘তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। তবে তোমাকে একটি বিষয়ে বলার জন্যই আসতে বলেছি। হয়তো তুমি ব্যাপারটি জেনে থাকবে, তবুও।’

সাজিদ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো, ‘জানা বিষয়টাও আপনার মুখ থেকে শুনলে মনে হয় নতুন জানছি। আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি তা তো আপনি জানেনই।’

বিপ্লব দা কোন ভূমিকায় গেলেন না। সরাসরি বললেন, ‘ওই যে, তোমার সৃষ্টিকর্তা, উনার ব্যাপারে বলতে চাই। তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি হয়তো এ ব্যাপারে জানো। সম্প্রতি বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার কোনো দরকার নেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে শুন্য থেকেই। আগে তোমরা, মানে বিশ্বাসীরা বলতে, একটা সামান্য সুঁচও যখন কোন কারিগর ছাড়া এমনি এমনি তৈরি হতে পারেনা, তাহলে এই গোটা মহাবিশ্ব কীভাবে তৈরি হবে আপনাআপনি? কিন্তু বিজ্ঞান এখন বলছে, এই মহাবিশ্ব শুন্য থেকে আপনাআপনিই তৈরি হয়েছে।কারো সাহায্য ছাড়াই।’

এই কথাগুলো বিপ্লব দা একনাগাড়ে বলে গেলেন।মনে হয়েছে তিনি কোনো নিঃশ্বাসই নেননি এতক্ষণ।

সাজিদ বললো, ‘অদ্ভুত তো। তাহলে তো আমাকে আবার নাস্তিক হয়ে যেতে হবে দেখছি। হা হা হা হা।’

সাজিদ চমৎকার একটা হাসি দিলো। সাজিদ এইভাবে হাসতে পারে, তা আমি আজই প্রথম দেখলাম। বিপ্লব দা সেদিকে মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হলো না। উনি মোটামুটি একটা লেকচার শুরু করেছেন। আমি আর সাজিদ খুব মনোযোগী ছাত্রের মতো উনার বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুনছিলাম। তিনি যা বোঝালেন, বা বললেন, তার সার সংক্ষেপ এরকম।-

‘পদার্থ বিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটি থিওরি আছে, সেটি হলো ‘কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান’। এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের মূল কথা হলো, ‘মহাবিশ্বে পরম শূন্যস্থান বলে আদতে কিছু নেই। মানে, আমরা যেটাকে ‘Nothing’ বলে এতদিন জেনে এসেছি, বিজ্ঞান বলছে, আদতে ‘Nothing’ বলতে কিছুই নেই। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই, যখনই কোনো শূন্যস্থান (Nothing) তৈরি হয়, সেখানে এক সেকেন্ডের বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে কণা এবং প্রতিকণা (Matter & anti-matter) তৈরি হচ্ছে, এবং একটির সাথে অন্যটির ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তোমরা জানো কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের ধারণা কোথা হতে এসেছে?’

আমি বললাম, ‘না।’

বিপ্লব দা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ এই ধারণা এসেছে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তা নীতি’ থেকে। হাইজেনবার্গের সেই বিখ্যাত সূত্রটা তোমরা জানো নিশ্চয়?’

সাজিদ বললো, ‘হ্যাঁ। হাইজেনবার্গ বলেছেন, আমরা কখনও একটি কণার অবস্থান এবং এর ভরবেগের সঠিক পরিমাণ একসাথে একুরেইটলি জানতে পারবো না। যদি অবস্থান সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর ভরবেগের মধ্যে গলদ থাকবে। আবার যদি ভরবেগ সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর অবস্থানের মধ্যে গলদ থাকবে। দুটো একইসাথে সঠিকভাবে জানা কখনোই সম্ভব না। এইটা যে সম্ভব না, এটা বিজ্ঞানের অসারতা না, আসলে এটা হলো কণার ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য।’

বিপ্লব দা বললেন, ‘এক্সাক্টলি। একদম তাই। হাইজেনবার্গের এই নীতিকে শক্তি আর সময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।হাইজেনবার্গের এই নীতি যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাবিশ্বে ‘শূন্যস্থান’ বলে কিছু থাকতে পারেনা। যদি থাকে, তাহলে তার অবস্থান ও ভরবেগ দুটোই শূন্য চলে আসে, যা হাইজেনবার্গের নীতিবিরুদ্ধ।’

এইটুকু বলে বিপ্লব দা একটু থামলেন। কফির পট থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘বুঝতেছো তোমরা?’

সাজিদ বুঝেছে কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হলেও, বিপ্লব দা’র উপস্থাপন ভঙ্গিমা সেটাকে অনেকটাই প্রাঞ্জল করে তুলছে। ভালো লাগছে।

বিপ্লব দা কফিতে চুমুক দিলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তাহলে তোমরা বলো না, যে বিগ ব্যাং এর আগে তো কিছুই ছিলো না। না সময়, না শক্তি, না অন্যকিছু। তাহলে বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরনটি হলো কিভাবে? এর জন্য নিশ্চয় কোন শক্তি দরকার? কোন বাহ্যিক বল দরকার,তাই না? এইটা বলে তোমরা স্রষ্টার ধারণাকে জায়েজ করতে। তোমরা বলতে, এই বাহ্যিক বলটা এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে। কিন্তু দেখো, বিজ্ঞান বলছে, এইখানে স্রষ্টার কোনো হাত নেই। বিগ ব্যাং হবার জন্য যে শক্তি দরকার ছিলো, সেটা এসেছে এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান থেকে। সুতরাং, মহাবিশ্ব তৈরিতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে বিজ্ঞান ডাইরেক্ট ‘না’ বলে দিয়েছে। আর, তোমরা এখনো স্রষ্টা স্রষ্টা করে কোথায় যে পড়ে আছো।’

এতটুকু বলে বিপ্লব দা’র চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে, উনি যে উদ্দেশ্যে আমাদের ডেকেছেন তা সফল হয়ে গেছে। আমরা হয়তো উনার বিজ্ঞানের উপর এই জ্ঞানগর্ভ লেকচার শুনে এক্ষুনি নাস্তিকতার উপর ঈমান নিয়ে আসবো।

যাহোক, ইতোমধ্যে সাজিদ দু কাপ কফি গিলে ফেলেছে। নতুন এক কাপ ঢালতে ঢালতে সে বললো, ‘এই ব্যাপারে স্টিফেন হকিংয়ের বই আছে। নাম- ‘The Grand Design’। এটা আমি পড়েছি।’

সাজিদের কথা শুনে বিপ্লব দা’কে খুব খুশি মনে হলো। তিনি বললেন, ‘বাহ, তুমি তাহলে পড়াশুনা স্টপ করোনি? বেশ বেশ! পড়াশুনা করবে। বেশি বেশি পড়বে।’

সাজিদ হাসলো। হেসে সে বললো, ‘কিন্তু দাদা, এই ব্যাপারে আমার কনফিউশান আছে।’

– ‘কোন ব্যাপারে?’ বিপ্লব দা’র প্রশ্ন।

– ‘স্টিফেন হকিং আর লিওনার্ড ম্লোদিনোর বই The Grand Design এর ব্যাপারে।’

বিপ্লব দা একটু থতমত খেলো মনে হলো। মনে হয় উনি মনে মনে বলছে এই ছেলে দেখছি খোদার উপর খোদাগিরি করছে।

তিনি বললেন, ‘ক্লিয়ার করো।’

সাজিদ বললো, আমি দুইটা দিক থেকেই এটার ব্যাখ্যা করবো। বিজ্ঞান এবং ধর্ম। যদি অনুমতি দেন।’

– ‘অবশ্যই।’ বিপ্লব দা বললেন।

আমি মুগ্ধ শ্রোতা। গুরু এবং এক্স-শিষ্যের তর্ক জমে উঠেছে।

সাজিদ বললো, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, স্টিফেন হকিংয়ের এই থিওরিটা এখনো ‘থিওরি’, সেটা ‘ফ্যাক্ট’ নয়। এই ব্যাপারে প্রথম কথা বলেন বিজ্ঞানি লরেন্স ক্রাউস। তিনি এইটা নিয়ে একটি বিশাল সাইজের বই লিখেছিলেন। বইটার নাম ছিলো- ‘A Universe From Nothing’।

অনেক পরে, এখন স্টিফেন এটা নিয়ে উনার The Grand Design এ কথা বলেছেন। উনার এই বইটা প্রকাশ হবার পর সি এন এনের এক সাংবাদিক হকিংকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?’

হকিং বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে, তবে মহাবিশ্ব তৈরিতে তার প্রয়োজন নেই।’

বিপ্লব দা বললেন, ‘সেটাই। উনি বোঝালেন যে, ঈশ্বর মূলত ধার্মিকদের একটি অকার্যকর বিশ্বাস।’

– ‘হকিং কী বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু হকিংয়ের ওই বইটি অসম্পূর্ণ। কিছু গলদ আছে।’

বিপ্লব দা কফির কাপ রাখতে রাখতে বললেন, ‘গলদ? মানে?’

– ‘দাঁড়ান, বলছি। গলদ মানে, উনি কিছু বিষয় বইতে ক্লিয়ার করেননি। যেহেতু এটা বিজ্ঞান মহলে প্রমাণিত সত্য নয়, তাই এটা বিজ্ঞান মহলে প্রচুর বিতর্কিত হয়েছে।

উনার বইতে যে গলদগুলো আছে, সেগুলো সিরিয়ালি বলছি।

গলদ নাম্বার – ০১

হকিং বলেছেন, শূন্য থেকেই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের মাধ্যমে বস্তু কণা তৈরি হয়েছে, এবং সেটা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিউট্রালাইজ হয়েছে।

এখানে প্রশ্ন হলো,- ‘শূন্য বলতে হকিং কি একদম Nothing (কোনোকিছুই নেই) বুঝিয়েছেন, নাকি Quantum Vacuum (বস্তুর অনুপস্থিতি) বুঝিয়েছেন সেটা ক্লিয়ার করেননি। হকিং বলেছেন, শূন্যস্থানে বস্তু কণার মাঝে কোয়াণ্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান হতে হলে সেখানে মহাকর্ষ বল প্রয়োজন। কিন্তু ওই শূন্যস্থানে (যখন সময় আর স্থানও তৈরি হয়নি) ঠিক কোথা থেকে এবং কীভাবে মহাকর্ষ বল এলো, তার কোন ব্যাখ্যা হকিং দেননি।

গলদ নাম্বার – ০২

হকিং তাঁর বইতে বলেছেন, মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে একদম শূন্য থেকে, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের মাধ্যমে। তখন ‘সময়’ (Time) এর আচরণ আজকের সময়ের মতো ছিলো না। তখন সময়ের আচরণ ছিলো ‘স্থান’ (Space) এর মতো। কারণ, এই ফ্ল্যাকচুয়েশান হবার জন্য প্রাথমিকভাবে সময়ের দরকার ছিলো না, স্থানের দরকার ছিলো। কিন্তু হকিং তাঁর বইতে এই কথা বলেননি যে, যে সময় (Time) মহাবিশ্বের একদম শুরুতে ‘স্থান’ এর মতো আচরণ করেছে, সেই ‘সময়’ পরবর্তী সময়ে ঠিক কবে আর কখন থেকে আবার Time এর মতো আচরণ শুরু করলো এবং কেন।’

আমি বিপ্লব দা’র মুখের দিকে তাকালাম। তাঁর চেহারার উৎফুল্ল ভাবটা চলে গেছে।

সাজিদ বলে যাচ্ছে-

গলদ নাম্বার – ০৩

পদার্থবিদ্যার যে সূত্র মেনে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হলো, তখন শূন্যাবস্থায় পদার্থবিদ্যার এই সূত্রগুলো বলবৎ থাকে কী করে? এইটার ব্যাখ্যা হকিং দেননি।

গলদ নাম্বার – ০৪

আপনি বলেছেন, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই, শূন্যস্থান পূরণ করতে আপনা আপনি কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, যেখানে আপনি শূন্যস্থান নিয়ে কথা বলছেন, যখন সময় ছিলো না, স্থান ছিলো না, তখন আপনি প্রকৃতি কোথায় পেলেন?’

সাজিদ হকিংয়ের বইয়ের পাঁচ নাম্বার গলদের কথা বলতে যাচ্ছিলো। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপ্লব দা বললেন,- ‘ওকে ওকে। বুঝলাম। আমি বলছি না যে এই জিনিসটা একেবারে সত্যি। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। আলোচনা-সমালোচনা হবে। আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। তারপর ডিসাইড হবে যে এটা ঠিক না ভুল।’

সাজিদের কাছে বিপ্লব দা’র এরকম মৌন পরাজয় আমাকে খুব তৃপ্তি দিলো।মনে মনে বললাম, ‘ইয়েস সাজিদ, ইউ ক্যান।’

সাজিদ বললো, ‘হ্যাঁ, সে পরীক্ষা চলতে থাকুক। যদি কোনোদিন এই থিওরি সত্যিও হয়ে যায়, তাহলে আমাকে ডাক দিয়েন না দাদা। কারণ, আমি কোরআন দিয়েই প্রমাণ করে দিতে পারবো।’

সাজিদের এই কথা শুনে আমার হেঁচকি উঠে গেলো। কী বলে রে? এতক্ষণ যেটাকে গলদপূর্ণ বলেছে, সেটাকে আবার কোরআন দিয়ে প্রমাণ করবে বলছে? ক্যামনে কী?’

বিপ্লব দা’ও বুঝলো না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রকম?’

সাজিদ হাসলো। বললো, ‘শূন্য থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা আল কোরআনে বলা আছে দাদা।’

আমি আরো অবাক। কী বলে এই ছেলে?

সে বললো, ‘আমি বলছি না যে কোরআন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের কথাই বলেছে। কোরআন যাঁর কাছ থেকে এসেছে, তিনি তাঁর সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন সেটা বিগ ব্যাং আসলেও পাল্টাবে না, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান থিওরি আসলেও পাল্টাবে না। একই থাকবে।’

বিপ্লব দা বললো, ‘কোরআনে কী আছে বললে যেন?’

– ‘সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতে আছে,

‘যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বে আনয়ন করেন (এখানে মূল শব্দ ‘বাদিয়্যু’/Originator- সেখান থেকেই অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের ধারণা) এবং যখন তিনি কিছু করবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন শুধু বলেন হও, আর তা হয়ে যায়।’

‘Creator of the heavens and the earth from nothingness, He has only to say when He wills a thing, “Be,” and it is’….

দেখুন, আমি আবারো বলছি, আমি এটা বলছি না যে, আল্লাহ তা’আলা এখানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের কথাই বলেছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি ‘অনস্তিত্ব’ (Nothing) থেকে ‘অস্তিত্বে’ (Something) এনেছেন। এমন না যে, আল্লাহ তাঁর হাত দিয়ে প্রথমে মহাবিশ্বের ছাদ বানালেন। তারপর তাতে সূর্য, চাঁদ, গ্যালাক্সি এগুলা একটা একটা বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি কেবল নির্দেশ দিয়েছেন।

হকিংও একই কথা বলছে। কিন্তু তারা বলছে এটা এমনি এমনি হয়ে গেছে, শূন্য থেকেই। আল্লাহ বলছেন, না, এমনি হয়নি। আমি যখন নির্দেশ করেছি ‘হও’ (কুন), তখন তা হয়ে গেলো।

হকিং ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের জন্য মহাকর্ষ বল কোথা থেকে এলো, ‘সময়’ কেন, কীভাবে ‘স্থান’ হলো, পরে আবার সেটা ‘সময়’ হলো।

কিন্তু আমাদের স্রষ্টা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘হতে’, আর তা হয়ে গেলো।

ধরুন একটা ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ম্যাজিশিয়ান বসে আছে স্টেজের এক কোনায়। কিন্তু সে তার চোখের ইশারায় ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দর্শক দেখছে, খালি টেবিলের উপরে হঠাৎ একটা কবুতর তৈরি হয়ে গেলো এবং সেটা উড়েও গেলো। দর্শক কি বলবে এটা কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের মাধ্যমে হয়ে গেছে? না, বলবে না। এর পেছনে ম্যাজিশিয়ানের কারসাজি আছে।সে স্টেজের এক কোনা থেকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছে বলেই এটা হয়েছে। স্রষ্টাও সেরকম। তিনি শুধু বলেছেন, ‘হও’,  আর মহাবিশ্ব আপনা আপনিই হয়ে গেলো। … আপনাদের সেই শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব কেবল ওই ‘হও’ পর্যন্তই।

মাগরিবের আজান পড়তে শুরু করেছে। বিপ্লব দা’কে অনেকটাই হতাশ দেখলাম। আমরা বললাম, ‘আজ তাহলে উঠি?’

উনি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এসো।’

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমি অবাক হয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছি। কে বলবে এই ছেলেটা ছ’মাস আগেও নাস্তিক ছিলো? নিজের গুরুকেই কীরকম কুপোকাত করে দিয়ে আসলো। কোরআনের সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতটি কতো হাজার বার পড়েছি, কিন্তু এভাবে কোনোদিন ভাবিনি। আজকে এটা সাজিদ যখন বিপ্লব দা-কে বুঝাচ্ছে, মনে হচ্ছে আজকেই নতুন শুনছি এই আয়াতের কথা। গর্ব হতে লাগলো আমার।

(এটি ‘সাজিদ’ সিরিজের ২য় পর্ব। সাজিদ একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই চরিত্রটি কাল্পনিক নানান ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে নাস্তিক তথা ইসলামবিদ্বেষীদের যুক্তিগুলোকে দর্শন, যুক্তি, বিজ্ঞান আর বাস্তবতা দিয়ে খন্ডন করে)

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive