ভূমিকা

হাজ্জ করার মানে এই নয় যে আমি আজ থেকে একজন বিশেষ ব্যক্তি হয়ে গেলাম অথবা নামের আগে আলহাজ্ব বসিয়ে সবার থেকে বিশেষ সুনজর ও সম্মান পাবার লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। হাজ্জ হলো ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা সম্পাদনের মাধ্যমে আমরা জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার একটা সুযোগ পাই। তাই হাজ্জকে জীবনের restart button বলা যেতে পারে।

যখন একটি দালান তৈরি করা হয়, তখন তার নিচে শক্ত গাঁথুনি দেবার প্রয়োজন পড়ে। মজবুত ভিত্তি না থাকলে, সেই বাড়ি বাতাসের ধাক্কায়ও হেলে পড়তে পারে। নিরেট ভিত্তির ওপর নির্মিত বাড়িটি যত সুন্দর করে তৈরি হয়, তত দীর্ঘদিন টিকে থাকে। কিন্তু বাড়িটির ভিত্তি স্থাপন হয়ে গেলে কি আমরা বাড়ির মালিকের প্রশস্তি গেয়ে বলি, “ভাই আপনি কি সুন্দর ভিত গড়েছেন, আপনি বিরাট গুণী মানুষ”???

IIRT Arabic Intensive

 ঠিক তেমনিভাবে হাজ্জ ইসলামের একটি অন্যতম রুকন বা ভিত্তি। ঈমান, নামায, রোজা, যাকাত ও হাজ্জ এই পাঁচটি কাজ যখন যার উপর ফরয হয়, তখন তাকে করতেই হয় এবং এর মাধ্যমে ইসলামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় মাত্র। আর ভিত্তি স্থাপন করেই অর্জনের আনন্দে অহংকারী হবার কিছু নেই। ভিত্তির উপর দালান নির্মাণের এখনো অনেক বাকি। বরং এক্ষেত্রে শোকরগুজার হওয়াই উত্তম। কারণ আল্লাহ্‌ আমাদের উনার ঘরের সফর করার তৌফিক দিয়েছেন।

আল্লাহ্‌ যখন আমার স্বামীকে আর আমাকে ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাইতুল্লাহর যিয়ারতের জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন, তখন এই ফরয দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা মক্কার উদ্দেশ্যে উড়াল দেই এবং শুরু হয় আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম ‘যাত্রা’। আমি যখনই কোনো ভ্রমণে যাই, তা কীভাবে যেন খুব ঘটনাবহুল সময়ে পরিণত হয়। হাজ্জে গিয়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যেহেতু সাধারণত আমি ভ্রমণকাহিনী লেখার চেষ্টা করি, তাই হাজ্জের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার সময়ও ভ্রমণ সংক্রান্ত নানারকম কাহিনী এর মাঝে ঢুকে পড়েছে।

আগেই বলে নিচ্ছি, হাজ্জের নিয়ামবলী লেখা আমার মূল উদ্দেশ্য নয়, এর জন্য বিশ্বখ্যাত আলেম উলামাদের বহু রচনা রয়েছে। এ বইতে হাজ্জ-কালীন সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধির চিত্রাঙ্কনের প্রয়াস নিয়েছি মাত্র। চেষ্টা করেছি এ লেখার মাধ্যমে হুজ্জাজদের ওপর আল্লাহ্‌র অপার অনুগ্রহের ছিটেফোঁটা হলেও তুলে ধরতে ও হাজ্জের উপলব্ধিটুকু ছড়িয়ে দিতে। এছাড়াও এখানে হাজ্জ সম্পর্কিত ইসলামী ইতিহাসগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করেছি। কারণ ইতিহাস জানা থাকলে হাজ্জের প্রত্যেক কার্যাবলীর গুরত্ব অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করা অনেক সহজ হয়ে যায়।

হারামাইন কী

হারাম শব্দের দুটো অর্থ আছে। একটি অর্থ আমাদের সবার জানা। যেকোনো নিষিদ্ধ বস্তুকে হারাম বলে। অন্য অর্থটি অনেকেরই অজানা, তা হলো ‘পবিত্র’। আল্লাহ্‌র ইবাদতের প্রাচীন ও সম্মানিত গৃহ কাবা সংলগ্ন মসজিদটি “মাসজিদুল হারাম” নামে পরিচিত। এই মসজিদের পবিত্র সীমানায় সকল হারাম কাজ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

আরবী ‘হারাম’ শব্দের দ্বিবচন হল ‘হারামাইন’। সৌদিতে বাইতুল্লাহ ও মসজিদে নববী নামের দুটি পবিত্র স্থান রয়েছে। এ দুটি মসজিদকে একত্রে হারামাইন বলা হয়। মসজিদ দুটো দেখাশোনার দায়িত্ব সৌদি সরকারের। তাই সৌদি বাদশাহের একটি উপাধি হলো “Custodian of the two Holy Mosques”, অর্থাৎ দুটো পবিত্র মসজিদের খাদেম।

শুরুর কথা

আমার আর সাফিরের জন্য “হারামাইনের দেশে” হাজ্জে যাওয়া ছিলো অনেকটা স্বপ্নের দেশে যাত্রার মতো। হঠাৎ করে ঝোঁকের বশে হাজ্জে গেছি, এ কথা বললেও ভুল হবে। অথবা আমরা প্রচুর অর্থের মালিক, এই দীর্ঘ যাত্রার আর্থিক সঙ্গতি করা আমাদের জন্য ছেলেখেলা – এমন ভাবাটাও সঠিক হবে না। হাজ্জ যাত্রা আমাদের জন্য ছিল সযত্নে  বহুদিন ধরে লালিত এক স্বপ্নের আশ্চর্য বাস্তবায়ন। এই বাস্তবায়ন করেছেন আল্লাহ্‌ রাহমানির রাহীম স্বয়ং। আমরা বহুদিন ধরে উন্মুখ হয়ে ছিলাম আল্লাহ্‌র ঘর দেখার জন্য, কিন্তু যার ঘর তাঁর ডাক না আসলে, কোনোভাবেই যাওয়া যে সম্ভব নয়, তা আমরা সে সময় প্রতি পদে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আল্লাহ্‌ যখন ডেকেছেন, শুধু তখনই যাওয়া সম্ভব হয়েছে, তার আগে কোনোভাবেই নয়।

আমার এখনো মনে পড়ে সেই দিনের কথা …

আমাদের বিয়েটা পুরোদস্তুর পারিবারিক ভাবে ঠিক করা হয়েছিলো। দয়া করে কেউ ভাববেন না মানুষ বিনা কারণে নিজেদের বিয়ের গল্প বলতে পছন্দ করে বলে আমি আমার বিবাহ বৃত্তান্ত বলতে যাচ্ছি। আমার বিয়ের সাথে হাজ্জে যাওয়ার কাহিনী ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা নাহলে এ কাহিনীর উল্লেখ করতাম না।

বিয়ে ঠিক হবার আগে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের জন্য দেখা ও কথা হয়েছিলো আমাদের। যদিও আমাদের কথার উপর ভিত্তি করে যে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাও কিন্তু না, বিয়ের সময় আমি বুঝতে পেরেছি যখন কোনো ঘটনা ঘটার থাকে, তখন তা কোনো মানুষের পক্ষে রদবদল করা সম্ভব নয়। অবধারিতভাবে সেই ঘটনা পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। আমার বিয়েও ঠিক তেমনভাবেই হয়েছিলো। সকল ঘটনা দুর্নিবার গতিতে পরিণতির দিকে ছুটছিলো, আর আমি নীরব দর্শকের মত বসে বসে দেখছিলাম।

বিয়ের ঠিক একদিন আগের কথা। হবু বর হবু কনেকে ফোন দিলো, কাবিন নামায় দেন মোহরের অঙ্ক জানানোর জন্য ও জিজ্ঞেস করার জন্য যে, তাদের নির্ধারণ করা মোহরের পরিমাণে আমি খুশি কি না। দেনমোহরের কথা বলার পর উনি বললেন কিছুদিনের মাঝে তাঁকে Mission এ যেতে হবে, ডিফেন্সের মানুষরা মিশনে গেলে এককালীন একটা বড় অঙ্কের টাকা পায়। তাছাড়া সরকারী চাকরিতে অর্থ জমা করা এত সহজ নয়। আল্লাহ চাইলে, এই টাকা দিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে হাজ্জে যাবার ইচ্ছা পোষণ করছেন। কারণ তখন তাঁর উপর হাজ্জ ফরজ হয়ে যাবে ।

আমার জন্য এ প্রস্তাব ছিলো সম্পূর্ণ অভাবনীয় এবং সেই সাথে অকল্পনীয়। এ যুগের কোনো ছেলে বিয়ের আগের দিন তার হবু স্ত্রীকে হাজ্জে নিয়ে যাবার কথা বলতে পারে, এমনতর কথা তো চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই খুব স্বাভাবিক লেগেছিলো, সানন্দে তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম।

আমাদের বিবাহিত জীবনের সূচনার সাথে সাথে কখন যে হাজ্জে গমন করার চিন্তাটা ‘ইচ্ছা’ থেকে ‘স্বপ্নে’ পরিণত হলো, তা আমরা নিজেরাও জানি না। জানি না কখন থেকে সেই স্বপ্নের বীজ ধীরে ধীরে তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে গেড়ে বসতে লাগলো আমাদের অন্তরের গহীনতম স্থানে। আর শুরু হলো আমাদের অপেক্ষা। বায়তুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র ঘরে হাজিরা দেবার অপেক্ষা …

প্রচেষ্টা, ব্যর্থতা এবং আবারো প্রচেষ্টার পালা

বিয়ের চার মাস পর সত্যি সত্যি সাফিরের মিশনে নাম চলে আসলো, এবং সে তার নবপরিণীতা স্ত্রীকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মিশনে চলে গেলো। সাফির যাবার আগে আমি প্রায়ই কাঁদতে বসতাম, আর ও বিদেশ যাবার মোহে বিভোর হয়ে কিছুটা বিরক্তির সাথেই মনে হয় আমার কান্নাকাটি সহ্য করতো। এরপর একদিন আমাকে দেশে রেখে সে লেবানন চলে গেলো এক বছরের জন্য।

যতটা উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে সাফির মিশনে যাবার প্রস্তুতি নিয়েছিলো, সত্যি যখন যাবার সময় হয়ে এলো, তখন তার সেই উৎসাহে যেন একটু ভাটার টান আসল। জীবনের নতুন সদস্য, অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ এই যুবতী মেয়েটির জন্য অচেনা এক দুঃখ মাখা মায়া অথবা মায়া মাখা দুঃখের অনুভূতি নিয়ে সে ইমিগ্রেশনের কাঁচের দেয়াল পার হলো। নতুন দেশে পৌঁছানোর পর তার অবশিষ্ট ভাটা পরা উৎসাহটুকুও সমূলে উৎপাটিত হলো।

দেশের আরাম আয়েশের জীবন থেকে বিদেশে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো, ইসরায়েল বর্ডারের পাশে টিন-শেড ছোট এক রুমে একা থাকতে হবে ও এই দম আটকে ধরা একাকী জীবনে নিজের হাতে রান্না করে খেতে হবে। অথচ সে আদা আর রসুনের চেহারা চিনতো না, এবং আক্ষরিক অর্থেই রান্নার ‘র’-ও জানতো না। যদিও সে লেবানন থেকে মোটামুটি মাস্টার শেফ হয়ে ফেরত এসেছে, দেশে এসে সেই অর্জিত জ্ঞান সে রান্নাঘরে প্রয়োগ না করে অন্যের রান্নার ভুল ধরতেই বেশি প্রয়োগ করতে লাগলো। আগে যা রাঁধতাম তা-ই খেতো, আর এখন এক চিমটি ধনে বেশি দিয়ে ফেললেও সে বুঝে যায়। আমার মতো নতুন রাঁধুনির জন্য তা একটা বড়সড় বিপর্যয়ের ব্যাপার হয়ে দেখা দিলো।

ওর মিশনের এক বছরের মাঝে আমাদের বিয়ের পর প্রথম কোরবানি ঈদ হলো। সাফিরের এক বন্ধু লেবানন থেকে হাজ্জে গেলেন। মাত্র ১৫ দিনে এবং অত্যন্ত কম খরচে হাজ্জ করে ফেললেন। কিন্তু সাফির আমাকে ফেলে গেলো না। ও যদি নিজে হাজ্জ করে ফেলে, তাহলে আমি পরে কীভাবে একা যাবো, এসব নানান চিন্তা করে সে ঈদ কাটাতে দেশে চলে আসলো।

তার পরের বছর আমরা হাজ্জে যাবার চেষ্টা করলাম। সরকারি চাকরি যারা করে, তাদের দেশের বাইরে যেতে হলে সরকার থেকে অনুমতি নিতে হয়। সাফির অফিস থেকে অনুমতি পেলো না। কারণ অফিসারের সংকট, তাই সিনিয়র অফিসারদের আগে হাজ্জের সুযোগ দেয়া হবে। কেউ যে হাজ্জের মত একটা কাজে, মক্কার মতো কোন পবিত্র স্থানে যাবার জন্য বাধা দিতে পারে, তা বিশ্বাস করা আমার জন্য কল্পনাতীত ব্যাপার ছিলো। প্রথমবার অনেক আশা নিয়ে চেষ্টা করে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফেরত আসলাম।

আশাটা বেশি ছিলো, তাই ব্যর্থতার ধাক্কাটাও অপ্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু তখন আমরা প্রথমবারের মতো অনুধাবন করলাম, আল্লাহ্‌র ঘরে আল্লাহ্‌র ডাক না আসলে যাওয়া সম্ভব না। হাজ্জ যাত্রীরা আল্লাহ্‌র মেহমান। তাই সেখানে যেতে হলে অবশ্যই তাঁর দাওয়াত লাগবে। আসলেই তো কত মানুষ স্বপ্ন দেখে হাজ্জে যাবার, নসিবে না হবার আগে কি কেউ যেতে পারে! কোনো কিছুই আল্লাহ্‌র হুকুম ছাড়া হয় না। তাই সে বছর আমরা দেশেই ঈদ করলাম। মক্কায় আর সেবার যাওয়া হলো না।

এর পরের বছর সাফিরকে অফিস থেকে প্রায় ৮ মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য সপরিবারে ভারত পাঠানো হলো। সেবার প্রবাস জীবনে আমি প্রথমবারের মতো ঈদ করলাম। ২ হাজার বছরের পুরনো এক দূর্গের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে ঈদ উল ফিতর কেটে গেলো আর প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে আনন্দ করে ঈদ উল আযহা অর্থাৎ হাজ্জের ঈদ কেটে গেলো। ঐ বছর বিদেশ থাকার কারণে হাজ্জের চেষ্টাও করতে পারলাম না।

ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে আসলাম। আমাদের বিয়ের পর এবার ৪র্থ কোরবানি ঈদ হবে। হাজ্জের প্রায় ৪/৫ মাস আগে থেকেই হাজ্জের টাকা জমা দিতে হয়, সে এক লম্বা processing। আমরা আবারো সরকারী অনুমতির জন্য দরখাস্ত জমা দিলাম। এই বার আর প্রথমবারের মত মনোভাব নেই। তখন আশা করিনি নিরাশ হবার। আর এই বার আশা- নিরাশার দোলাচলে অপেক্ষা করছি।

আমি তখন ঢাকায় আর সাফির চট্টগ্রামে। একদিন রাতে ও আমাকে জানালো এই বার অনুমতি পাওয়া গেছে। আহা, সে ছিল এক আনন্দময় মুহূর্ত। আমাদের কত দিনের স্বপ্নে অবশেষে আশার আলো দেখা গেলো। এই অল্পবয়স্ক দম্পতির মন সেদিন যে কতটা অপার্থিব আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো, তা শুধু মাত্র এই আনন্দ দেবার মালিক যিনি তিনিই জানেন। আল্লাহু আকবার। আল্লাহ্‌ সুমহান। তিনি কত সহজে তাঁর বান্দাদের মনে খুশির জোয়ার বইয়ে দিতে পারেন।

বাংলাদেশে এই বয়সে অনেকেই হাজ্জে যেতে পারে না। আমি মনে করি আর্থিক কারণটাই এখানে মুখ্য। এছাড়া সামাজিক কিছু কারণ ও বহুল প্রচলিত ধ্যান-ধারণা আছে, যেমন অনেকে বলে, “জীবনে যত পাপ করার আছে করে নেই, বুড়ো বয়সে হাজ্জ করে নিষ্পাপ হয়ে আসবো।” আবার কেউ বা মনে করে, অল্প বয়সে হাজ্জ করলে হাজ্জ পরবর্তী জীবন যেমন হওয়া উচিত, তেমন করে কি চলতে পারবো? হাজ্জের শিক্ষা কি পরবর্তী জীবনে কায়েম রাখতে পারবো?

এরকম আরো কত ভাবনা আসে মানুষের মনে। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্য, এই সব ধরনের মানুষের অধিকাংশই আল্লাহ্‌কে বিশ্বাস করে, ভয় পায় ও ভালোবাসে। কেউ আল্লাহ্‌কে ভয় পেয়ে ও ভালবেসে টাকা পয়সার সংস্থান হলেই হাজ্জ করতে ছুট লাগায়, কিছু মাত্র দেরি করে না। আবার কিছু মানুষ তাঁকে হয়ত অন্য ধরনের ভালবাসে। তারা ভাবে হাজ্জের পর যদি ভালভাবে চলতে না পারি, তাহলে যদি আল্লাহ্‌ আরো অসন্তুষ্ট হন, এই ভয়ে তাঁরা বুড়ো বয়সের জন্য অপেক্ষা করেন।

কিন্তু হাজ্জ ফরজ হবার পর ত্বরান্বিত করার কথাই ইসলামে বলা হয়েছে। কোনো ফরজ ইবাদত ‘পরে’ করার জন্য ফেলে রাখা উচিৎ নয়। তাছাড়া হাজ্জ আমাদের ইসলামের ৫ টি ভিত্তির মাঝে একটি। তাই এর গুরুত্ব যে কতখানি, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। জীবনে মাত্র একবার হাজ্জ ফরজ। অর্থাৎ ৫/৬ দিনের এই আনুষ্ঠানিকতাগুলো যদি সঠিক উপায়ে, মন দিয়ে পালন করা যায়, তাহলে সারা জীবনের জন্য একটা ফরজ কাজ করা হয়ে যাবে।

সত্যিই হাজ্জের সময় যখন মনে হতো, মাত্র এই কটা দিন সুচারুরূপে সব সম্পন্ন করতে পারলে, সারা জীবনের জন্য একটা ফরজ দায়িত্ব পালন করা হয়ে যাবে!! আশ্চর্য লাগতো তখন!! যেখানে সালাত, যাকাত, রোজা- যতদিন আয়ু থাকে, তত দিন সামর্থ্যবানদের উপর সময়মতো করা ফরজ, সেখানে হাজ্জ জীবনে মাত্র এক বার ফরজ!! আসলে হাজ্জের এই অল্প কিছুদিনের গুরুত্ব যে কত বেশি, তা এই স্বল্প জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

এই অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো কতটা সহিহভাবে কাটাতে পেরেছি জানি না। আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন। কিন্তু কেমন যেন আফসোস লাগে মাঝে মাঝে। মনে হয় যারা অনেক ধার্মিক ও আল্লাহ্‌র জন্য অনেক বেশি দিওয়ানা, তারা গোপনে নিভৃতে, অনেক নিখুঁতভাবে হাজ্জের দিনগুলো অতিক্রান্ত করেছেন। আমরা কি তাঁদের ধারে কাছেও কখনো পৌঁছাতে পারবো! আল্লাহ্‌ যেন সবাইকে সেই তৌফিক দেন।

প্রস্তুতি পর্ব

আমাদের সব কিছু করা হয় শেষ মুহূর্তে। আমরা টাকাও জমা দিলাম এক্কেবারে শেষের দিকে (যদিও পরে সময় বাড়ানো হয়েছিলো)। টাকা জমা দেবার পর শুরু হলো হাজ্জে যাবার প্রস্তুতি নেয়া। সহিহ বইপত্র জোগাড় করার উপর আমাদের focus ছিলো সবচেয়ে বেশি। কারণ বাংলাদেশে এই একটা জিনিসের প্রচণ্ড অভাব। এদেশে বিভিন্ন উৎস থেকে জাল হাদিস, উপযুক্ত প্রমাণ ও উৎস ছাড়া তথ্যে সয়লাব যে সমস্ত বই পাওয়া যায়, সেসব পড়ে সঠিক তথ্য জানার পরিবর্তে ভ্রান্ত ধারণায় মস্তিষ্ক পূর্ণ হবার সম্ভাবনা বেশি। এ সমস্ত বইয়ের অনুসারীদের যদি সহিহ আকিদার কোনো বই দেখানো হয়, তাহলে তারা আপনাকে ‘ওহাবি’ বলে গালি দিয়ে উড়িয়ে দেবে।

আমরা হাজ্জ সংক্রান্ত কোনো বই পড়ার ক্ষেত্রে সর্বদা প্রাধান্য দিয়েছি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা লেখকদের বইকে। ইসলাম বিষয়ক পড়াশোনার জন্য এই ইউনিভার্সিটি সবচেয়ে বিখ্যাত। তাই এখান থেকে পাশ করা মানুষদের লেকচার এবং বই কেনা বাজারের অন্য যেকোনো বইয়ের চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য হবে, তাতে আশা করা যায়। যদিও কোনো এক বিচিত্র কারণে এসব বই দেখলে বাংলাদেশের so called লেখকদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। অথচ এগুলোতে ইসলামকে অনেক সহজভাবে প্রকাশ করা হয়েছে!

হাজ্জে যাবার আগে জ্ঞান অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। জীবনের এত বড় একটা ইবাদত করার আগে পর্যাপ্ত পড়াশোনা না করে গেলে পুরো হাজ্জ নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই যারা শিক্ষিত, তাদের উচিত অন্তত হাজ্জের কয়েক মাস আগে থেকে পড়ালেখা শুরু করা। সারা জীবন যারা প্রচুর বইখাতা মুখস্থ করে বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেছে, তারা যদি হাজ্জের সময় সঠিকভাবে জ্ঞান অর্জন না করে হাজ্জে চলে যায়, সেটা হবে চরম বোকামি। তাই বলে কেউ যদি ভয় পেয়ে যায়, “হায় হায় এত পড়তে হবে হাজ্জ করতে হলে?? কী মুশকিল!!” তাদের জন্য খুশির খবর হলো, হাজ্জে কোন বিষয়গুলো করা উচিত নয় সেসব জানার জন্যই ‘পড়া’টা জরুরি। কারণ কোনোরকম দু’আ কালাম মুখস্থ না করে, শুধুমাত্র বই দেখে দু’আ পড়েও হাজ্জ করা যায়।

অধিকাংশ মানুষ তাদের সমগ্র জীবন ধরে হাজ্জ করার জন্য পয়সা জমাতে থাকেন। অতঃপর, বহু কষ্ট স্বীকার করে, জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে তাঁরা আল্লাহ্‌কে ভালবেসে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে হাজ্জে আসেন। এত কিছুর পর যদি তাঁরা হাজ্জের নিয়ম ও সকল আহকাম সঠিক ভাবে সম্পন্ন করতে না পারেন, এর চেয়ে কষ্টের বিষয় আর কী হতে পারে? এক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো, বাজারে যদি ভ্রান্ত তথ্যবহুল বইয়ের সমাহার থাকে এবং কতিপয় হাজ্জ এজেন্সি থেকেও যদি এ ধরনের বই সরবরাহ করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষদের আর কী দোষ? সবার পক্ষে তো আর সহিহ কোনটা আর ভুল কোনটা তা খুঁজে বের করা সহজ নয়।

হাজ্জ সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে আমার নিজস্ব যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হলো – কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তথ্যের উৎসের দিকে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন এবং সহিহ হাদিস থেকে উৎসারিত তথ্য সম্পর্কে নিঃসন্দেহ থাকতে হবে, শুধু আয়াতের তাফসির আর হাদিসটি কোন প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে তা দেখা ভালো। এছাড়া কোনো বইতে যদি ‘অমুক’ ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন বা কেউ স্বপ্নে দেখেছেন অথবা কোনো কেচ্ছা-কাহিনী দিয়ে ধর্মীয় বিধানের ব্যখ্যা দেবার চেষ্টা করা হয়, তবে সে সকল তথ্য সহিহ কি না, তা যাচাই করা আবশ্যক। আমরা আশৈশব যেসব ইসলামিক নিয়ম কানুন দেখে ও শুনে আসছি, সেগুলোও সহিহ দলিলের আলোকে একবার নতুন করে ঝালাই করে নেয়া বাঞ্ছনীয়।

যা হোক, হাজ্জের নানা প্রস্তুতির মাঝে কাপড়চোপড় সেলাই করাও পড়ে। সৌদি আরবে গিয়ে যদি প্রয়োজনীয় জিনিস না পাওয়া যায়, সেই আশঙ্কায় ছুরি, কাঁচি, থালা, বাটি থেকে শুরু করে নতুন কাপড়, কাপড় ধোবার সাবান, কাপড় শুকানোর ক্লিপ, এমন কি সুঁই, সুতা থেকে শুরু করে বোতাম পর্যন্ত কিছুই কেনা বাদ রাখলাম না। তাছাড়া ওর ইহরামের কাপড়, বেল্ট, বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ, স্যান্ডেল ইত্যাদি ক্রয় করা তো অবশ্য কর্তব্যের মাঝে পড়ে।

ওদিকে মক্কায় যেয়ে দেখি হেন বস্তু নাই, যা সেখানে পাওয়া যায় না। স্পঞ্জের স্যান্ডেল থেকে শুরু করে পা এর গোড়ালি ডলার জন্য ঝামার মত আনকমন জিনিসও সেখানে পাওয়া যায়। মক্কা গিয়ে যাবতীয় দ্রব্যের বিপুল সমাহার দেখে মনে হচ্ছিল, এত কেনা কাটা না করে  কাঁধে একটা ব্যাক-প্যাক ঝুলিয়ে অথবা ছোট একটা সুটকেস নিয়ে হাজ্জে চলে আসলেই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষকে দেখেছি তারা ছোট একটা পুল-ম্যান নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে, আর হারাম শরিফের ভিতরে ২৪ ঘণ্টা পড়ে থাকছে। এদিকে আমরা কী করেছি!! তিনটা সুটকেস, একটা ব্যাক-প্যাক, দুইটা হ্যান্ড ব্যাগ ইত্যাদি টানা টানি করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে গিয়ে ল্যাজে-গোবরে হয়েছি। এক কথায় নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতায় আমরা যারপরনাই বিরক্ত হলাম!

অহেতুক হরেক রকম কাপড় বয়ে নিয়ে গেছি ঐ দেশে, যদি কাপড় না শুকায়, যদি সিনথেটিক কাপড়ে গরম লাগে, কত রকমের উদ্ভট চিন্তা করেছি এখানে আসার আগে। আর সৌদি আরবে পৌঁছে দেখলাম, এদেশে ২/৩ টা কাপড় নিয়ে আসা যথেষ্ট। এখানে আর্দ্রতা এতই কম, ছাদে কাপড় শুকাতে দিলে অতি অল্প সময়ে কাপড় শুকিয়ে খট খটে হয়ে যায়। বাংলাদেশে আর্দ্রতা যেখানে ৭৩% , সেখানে সৌদিতে আর্দ্রতা মাত্র ২৬%। তাই এখানে গরম কাপড় পরে ঘুরে বেড়ালেও তেমন গরম লাগবে না। ঘাম হয় খুব কম। শুধু রোদের কারণে শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢেকে রাখতে হয়, না হলে রোদে চামড়া পুড়ে যাবে।

কেনাকাটা করবার পাশাপাশি, যাবার আগে যারা আগে হাজ্জে গেছে, তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরামর্শ নেবার চেষ্টা করেছি। এবং তারা প্রাণ খুলে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু উপদেশ দিয়েছে। মাঝে মাঝে তাদের কথাবার্তা পরস্পরবিরোধী হয়ে যেতো। আর আমরাও কনফিউসড হয়ে যেতাম। বেশ ক’মাস ধরে আমরা নানা রকমের প্রস্তুতি নিলাম, তারপরও শেষের দিনগুলোতে একটা হুড়াহুড়ি লেগে গেলো, দেখা গেলো আমরা বহু কাজ আধা খেঁচড়া করে রেখেছি, কিংবা অনেক কাজের কথা খেয়ালই ছিলো না।

যেমন, হাজ্জের জন্য সাদা বোরকা বানানো হয়নি। আমার পরিচিতদের থেকে শুনলাম অধিকাংশ মানুষ সাদা বোরকা অথবা সাদা কামিজ নিয়ে যায় হাজ্জে। আমি নির্বোধের মতো এত কিছু কিনলাম কিন্তু সাদা কিছু কিনলাম না নিজের জন্য। হায়, এই আফসোস এখন কোথায় রাখি! পরে যদিও আমি মক্কায় যেয়ে টের পেয়েছি, সাদা কাপড় না এনে ভালোই হয়েছে। কারণ সুতি সাদা কাপড় রোদের মাঝে আরামদায়ক হলেও, খুব দ্রুত ময়লা হয়ে যায় ও মক্কায় পৌঁছার কিছুদিনের মাঝেই উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে আর হাজ্জের সময় এগিয়ে আসতে আসতে সব পুরানো কাপড়ের মত মলিন হয়ে যায়।

আমাদের নানা রকমের লাগেজের ভিড়ে সত্যিকারের দরকারি কিছু জিনিস ছিলো। যার মাঝে একটি হলো, নানা রকমের ঔষধপাতি। মক্কায় ঔষধের দাম অনেক বেশি। প্রতি দেশের সরকার থেকে ফ্রি ডাক্তার থাকলেও সেই ডাক্তারের কাছে দেখাতে হলে লম্বা লাইন ধরতে হয়। অনেক সময় ডাক্তারখানা থেকে হোটেলের দূরত্ব যথেষ্ট বেশি হয়। তাই জ্বর, সর্দি কাশি, পেট খারাপ ইত্যাদি কমন সমস্যার জন্য ঔষধ সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াটা ভালো। নিজের না লাগলেও গ্রুপের কারো না কারো তো লাগবেই। যেমন শেষপর্যন্ত দেখা গেছে, আমার নিয়ে যাওয়া ঔষধগুলো আল্লাহ্‌র রহমতে দরকারের সময় অসম্ভব কাজে লেগেছে।

ধীরে ধীরে আমাদের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। প্রতীক্ষার প্রহর প্রায় শেষ হলো বলে।

সবার ভালবাসার জোয়ার

হাজ্জ নিয়ে রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর একটি দু’আ আছে। তিনি আল্লাহ্‌র কাছে দু’আ করেছিলেন তাঁর হাজ্জ যেন ‘রিয়া’ (লোক দেখানো) এবং ‘সুময়া’ (মানুষের থেকে attention পাবার ইচ্ছা) মুক্ত হয়। আমাদের সমাজে এভাবে হাজ্জ করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে তো জ্ঞাতি-গুষ্টিকে না জানিয়ে গেলে তারা অভিমান করে বসে, তার উপর আমার আর সাফিরের মা প্রবল উৎসাহে আমাদের চার কুলের আত্মীয়, বন্ধু বান্ধব সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন, আমরা হাজ্জে যাচ্ছি। মা’দের যদি মানা করি, তাহলে তাঁদের উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। আমাদের মাতৃদ্বয় আনন্দ রাখার আর জায়গা না পেয়ে দিকে দিকে সেই আনন্দ ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। ফলাফলস্বরূপ অল্প কিছুদিনের মাঝেই এই বিষয় আমাদের আত্মীয় এবং বন্ধুমহলে ‘টক অফ দা টাউন’ হয়ে গেল।

হাজ্জে যাবার আগে কোনো ঋণ থাকলে তা শোধ করার চেষ্টা করতে হয়, কারো মনে কখনো কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে তার থেকে মাফ চেয়ে নিতে হয়। এজন্য আরো কিছু মানুষকে জানাতে হলো আমাদের “হাজ্জ গমন” সম্পর্কে। যে কারণে যাত্রার আগের দিনগুলো কেটে গেলো আত্মীয়দের বাসায় যেয়ে বিদায় নিতে নিতে এবং যাবার আগের দিন রাত পর্যন্ত আত্মীয় স্বজনরা পালাক্রমে দলে দলে দেখা করতে আসতে লাগলো। সব মিলিয়ে একেবারে উৎসব উৎসব পরিবেশ সৃষ্টি হলো। কেউ আবার খালি হাতে আসে না, সঙ্গে করে হাতে বানানো পিঠা পুলি থেকে শুরু করে আমাদের জন্য প্রচুর খাবার দাবার নিয়ে আসে এবং সবাই আমাদেরকে হঠাৎ করে খুব ভালো মানুষ ভাবতে শুরু করলো, যতটা ভালো মানুষ হয়তো আমরা না। এককথায় সকলের ভালবাসায় জর্জরিত হয়ে মরমে মারা যেতে লাগলাম। কোথায় আমরা আল্লাহ্‌র ঘরে তাঁকে খুশি করার জন্য যাবার চেষ্টা করছি, সেখানে সবার স্নেহের আতিশয্যে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম।

আল্লাহ্‌র প্রতি সবার আবেগ ও ভালোবাসার এক অন্য রূপ দেখতে পেলাম সে সময়। সবাই আমাদের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আমাদের দেখতে এসেছে, তা-ও কিন্তু না। আল্লাহ্‌র ঘরে যারা আগে গিয়েছে, তারা স্মৃতি-কাতর হয়ে আমাদের দেখতে আসতো। আর যারা এখনো যেতে পারেনি, তারা আমাদেরকে দেখে নিজেরাও আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় ভবিষ্যতে হাজ্জে যাবার স্বপ্ন দেখতো। তাদের সবার আবেগের প্রাবল্য আর অনেকের অশ্রুসজল চোখ দেখে বুঝলাম, আমরা যতই দুনিয়ার পেছনে ছুটতে থাকি না কেন, কিছু কিছু সময়ে নিজের অজান্তেই আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। তখন অনুভব করতে পারি আমাদের অন্তরের একেবারে গহীন কোনো স্থানে, আমাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই সুমহান সত্ত্বার প্রতি মজবুত এক ভালোবাসা আছে, যার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই!

আল্লাহ্‌ আমাদের সৃষ্টি করার পর সবার রূহ থেকে একটি প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন। আমরা সবাই তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমাদের রব একজন আর তিনি হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। যে কারণে একজন ঘোরতর নাস্তিককেও যদি আচমকা জিজ্ঞেস করা হয়, কে তোমার রব? তখন সে-ও বলে বসবে “এক আল্লাহ্‌ আমার রব।” আর হয়তো এই প্রতিজ্ঞার কারণেই আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে আল্লাহ্‌র প্রতি রয়েছে এক নিয়ন্ত্রণহীন ভালোবাসা। অবশ্যই সমস্ত প্রশংসার মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামিন, যিনি আমাদের  জানা ও অজানা সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। যিনি আমাদের অন্তরে তাঁর জন্য ভালবাসা দেন, তিনিই যেন আমাদের এই অনুভূতির হেফাজত করেন।

সবাই আমাদের শুভকামনা জানানোর সাথে সাথে একটি আবদার জানাচ্ছে, তা হলো তাদের জন্য যেন হারাম শরীফে আর আরাফাতের ময়দানে যেয়ে দু’আ করি। এখানে মুশকিলের ব্যাপার হলো, অনেকেই বলছে তাদের অথবা তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য নাম ধরে দু’আ করতে হবে। বোধহয় ধরে নিয়েছে তারাই শুধু আমাদের কাছে এই অনুরোধ করছে। আহারে! উনারা যদি জানতেন কী বিপুল সংখ্যক মানুষ আমাদের কাছে অবিকল এক অনুরোধ করছে, এতজনের নাম আমার ঐখানে গিয়ে মনে থাকবে এই আশা তো আমি স্বপ্নেও করি না। আর তাদের যদি আমি কথা দেই, তাহলে তো সেই কথা না রাখলেও সমস্যা। এমনসময় এক জন পরিচিত শিখিয়ে দিলেন, সবার নাম তো মনে রাখা সম্ভব নয়, বরং আল্লাহ্‌র কাছে দু’আ করতে, “হে আল্লাহ্‌ যারা আমাকে দু’আ করতে বলেছে তুমি তাদের সবার দু’আ কবুল করো।” বাহ, কত সহজ সমাধান। এর পাশাপাশি আমার মা আবার বলে দিলেন, আমি যেন বলি, “হে আল্লাহ্‌ তুমি তাদের নেক দু’আ কবুল কর।”

মক্কায় যাবার কয়েকদিন আগে রিদওয়ান একদিন সৌদি চ্যানেল দেখছিলো টিভিতে। সেখানে হারাম শরীফে মানুষের তওয়াফ করা দেখাচ্ছিলো। হঠাৎ করে আমার মনে হচ্ছিলো, সত্যিই কি আমি যেতে পারবো এ জায়গায়? সব কিছু সহি সালামতে হলে আগামী সপ্তাহে এই সময়ের মাঝে আমরা সৌদি আরব থাকবো। ততদিনে আমাদের উমরাহ করা হয়ে যাবে। হায়! অপেক্ষার দিন আর শেষ হয় না। যদি সম্ভব হতো আমার সমগ্র সত্ত্বা উড়ে চলে যেতো আল্লাহ্‌র ঘরের সামনে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি কিন্তু ভেতরের আবেগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর একটা ভয় মনে মনে কাজ করছে, হাজ্জ পরবর্তী জীবনে কি হাজ্জ এর শিক্ষা বজায় রাখতে পারবো? ইনশাআল্লাহ্‌ পারবো, আল্লাহ্‌ যেন সব কিছু সহজ করে দেন এই আশায় আছি।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive