মেঘলা আকাশ। কয়েকদিন ধরেই ভ্যাপসা গরম। বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। তার উপর বাসভর্তি মানুষ। হঠাৎ করেই একটি কাজে গ্রামের বাড়ি যেতে হচ্ছে। অন্য কোনো বাস না পেয়ে শেষপর্যন্ত স্বনামধন্য (?!) বিআরটিসি বাসের উপরই আস্থা রাখছি। আমার সিট পিছনের দিক দিয়ে ৩ নাম্বার লাইনে। পাশের সিটে বসেছেন আমার বয়সের এক ভাই। সামনের সিটে এক মা তার সাত-আট বছরের ছেলেকে নিয়ে বসেছেন। ছেলে অনবরত বকবক করে যাচ্ছে। একদিকে পাশে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করা লোকের ভিড় এত বেশি যে, পাশে দাঁড়ানো যাত্রী প্রায় আমার কোলে উঠে পরছে। তার ওপর এই পিচ্চির বকবকানির জন্য মাথা ধরার  মত অবস্থা।

হঠাৎ করে খেয়াল করলাম ছেলেটি সূরা ফাতিহা পড়া শুরু করেছে। আর তার মা ভুল শুধরে দিচ্ছেন। এরপর ছেলেটি ক্রমান্বয়ে তার মায়ের সাথে সূরা কাওসার, সূরা নাস, সূরা ফালাক, সূরা ইখলাস পড়ল। তারপর শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। মা ছেলেকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে ছেলেটি নির্ভুলভাবে সবগুলোর উত্তর দিচ্ছে। সবগুলোই ধর্মীয় প্রশ্ন। আমাদের নবী কে, নবীজির মায়ের নাম কি, কুরআনে কয়টি সূরা রয়েছে, কুরআনে পাড়া কয়টি ইত্যাদি। মা-শা আল্লাহ। আনন্দে মনটা ভরে গেল। যে পিচ্চির বকবকানি মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল, খেয়াল করলাম আধাঘণ্টা ধরে তার বকবকানিই মনোযোগ দিয়ে শুনছি।

এমন দৃশ্য আমাদের পথে ঘাটে দেখা যায় না। আমাদের যুবকদের কানে থাকে হেডফোন। তাতে ফুল ভলিয়ুমে বাজে গান। হাতে থাকে মোবাইল যার স্ক্রিনে চলে সিনেমা, নাটক আর আইটেম সং। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে গানের কোচিংয়ে পাঠাই, নাচের ক্লাসে পাঠাই, গিটার শেখাই, শেখাই না শুধু কুরআন টা। আমাদের কুরআন শিক্ষা কোনরকমে আরবি দেখে পড়তে পারা আর পাঁচ-ছয়টা সূরা মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রাইমারিতে থাকতে যে কুরআন শেখা হয়েছিল না পড়ার কারণে স্কুল জীবন শেষ করার আগেই আমরা তা ভুলে বসে থাকি।

গান বাজনা আমাদের সমাজে একটি প্লেগ। মহামারীর মতোই তা গ্রাস করেছে আমাদের পুরো সমাজকে। আমরা তা বুঝতেও পারছি না। অধিকাংশ মানুষ বাদ্যযন্ত্র হারাম জেনেও তা শুনে যাচ্ছে। তাদের ধারণা নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, সুদ খাচ্ছি না, সামান্য গান-বাজনাতে আর কি হবে? এটি আসলে শয়তানের একটা ধোকা। শয়তান আপনাকে শুরুতেই শির্ক কিংবা কুফরীর দিকে আহ্বান করবে না। শয়তান আপনাকে প্রথমে বিভিন্ন সগিরা গুনাহ ও প্রাথমিক লেভেলের কবীরা গুনাহে লিপ্ত করাবে। ক্রমান্বয়ে এসব গুনাহ করতে করতে আপনার ঈমান দুর্বল হয়ে যাবে। একসময় আপনি শির্ক কিংবা কুফরীর মত বড় ধরনের কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়ে যাবেন এবং নিজেই বুঝতে পারবেন না।

বাদ্যযন্ত্র এবং অনৈতিক সংগীত কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে।”[১] বেশীর ভাগ তাফসীরকারকগণ এই আয়াতে ব্যবহৃত আরবী শব্দ ‘লাহওয়াল হাদীস’ বলতে ‘গান’কে বুঝিয়েছেন। সাহাবাদের ভেতর উলামা, ফুকাহা এবং মুফাসসীরিন হিসেবে পরিচিত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা)- তিনজনই এই আয়াতকে বাদ্য-বাজনা হারাম হওয়ার দলীল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেন, “উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যা বান্দাকে কুরআন থেকে গাফেল করে দেয়”।[২] আবু বকর (রা.) গানবাদ্যকে শয়তানের বাঁশি বলে আখ্যায়িত করেছেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা অভিশপ্ত শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমার আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্যে যাকে পার সত্যচ্যুত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও ও তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র।”[৩] এই আয়াতে ‘আওয়াজ’ বলতে প্রলোভনমূলক আহ্বান অথবা গান-বাজনা ও রঙ-তামাশার  মত আরো অন্যান্য শব্দকে বোঝানো হয়েছে।[৪] যেগুলোর মাধ্যমে শয়তান অধিকহারে লোকদেরকে ভ্রষ্ট করছে।

আমাদের ঈমান ও আমলের উপর গানবাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। গান বাজনা-

ক) নিফাক এর উৎস।

খ) ব্যভিচারের প্রেরণা জাগ্রতকারী।

গ) মস্তিষ্কের উপর আবরণ।

ঘ) কুরআনের প্রতি অনিহা সৃষ্টিকারী।

ঙ) আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী।

চ) গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও

ছ) জিহাদী চেতনা বিনষ্টকারী[৫]

বিয়ের অনুষ্ঠানে কিংবা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে আমাদের সন্তান যখন গান পরিবেশন করে কিংবা গানের তালে তালে নাচ দেখিয়ে সকলের মনোরঞ্জন করে, তখন আমাদের গর্বের শেষ থাকেনা। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।”[৬] জি। আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার কথাই বলে গিয়েছিলেন চৌদ্দশ’ বছর আগে। আর আপনার এতোটুকু লজ্জা হচ্ছে না। আপনি উল্টো গর্ব বোধ করছেন।

আমার পাশের সিটে বসে থাকা ভাই মহানন্দে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছেন। শব্দ এত বেশি যে আমি নিজেই বাজনা শুনতে পাচ্ছি। আচ্ছা, ব্যাটার গালে আচমকা এক চড় কসালে কেমন হয়? ব্যাটা বুঝবে কত ধানে কত চাল।

তথ্যসূত্র

[১] সূরা লুকমান (৩১:৬)

[২] তাফসীর ইবনে কাসীর, ৩/৪৫১।

[৩] সূরা ইসরা (১৭:৬৪)।

[৪] তাফসীরে আহসানুল বায়ান।

[৫] ইগাছাতুল লাহফান, লেখক: ইবনুল কাইয়্যিম আল জাউজিয়া রাহিমাহুল্লাহ।

[৬] সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৫৯০।


লেখক: আশরিন তামিম

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

2 Responses

Leave a Reply to ইসতিয়াক Cancel Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive