জেলের খাঁচার ভেতর থেকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমার অষ্টম শরৎ পার করছি।

যদিও আমি সরাসরি সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছি, বাস্তবতা হলো আমি পৃথিবীর যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, তা বছরের এই সময়ে সূর্য থেকে কিছুটা হেলে রয়েছে। এর অর্থ হলো, সূর্যের আলো সরাসরি না এসে কিছুটা বাঁকা হয়ে পড়ছে। ফলে এর উত্তাপ অনেকটা কমে গেছে। এই কারণেই আমরা এখানে তীব্র শীত অনুভব করছি। আমরা এই শীতের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারি, কিন্তু পৃথিবীর আবর্তন বা কক্ষপথকে পরিবর্তন করে শীতকে দমিয়ে রাখতে পারি না। আল্লাহ এই সময়ের জন্য প্রকৃতিকে এভাবেই সাজিয়েছেন, যা আমরা চাইলেও পরিবর্তন করতে পারি না। আল্লাহ বলেন, “আমিই সময়। আমিই দিন এবং রাতের আবর্তন ঘটাই। আমি যদি চাই তাহলে উভয়কে আটকে রাখতে পারি।” আমরা সময়ের গতিবিধিকেও পরিবর্তন করতে পারি না। আর সময় তো শেষের দিকেই (কিয়ামতের দিকে) এগিয়ে যাচ্ছে।

IIRT Arabic Intensive

আমরা সেই বাস্তবতাকেও পরিবর্তন করতে পারি না যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “সময় সংকুচিত হয়ে যাবে।” এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহঃ) লিখেন, “সময়ের সংকুচিত হওয়ার অর্থ হলো এর বরকত উঠে যাওয়া। যেমন সম্পূর্ণ এক দিনে কেবলমাত্র এক ঘন্টার সমান বরকত পাওয়া যাবে।” ইবনে আবি জামরাহ (রহঃ) এ সম্পর্কে লিখেন, “বেশ কিছু সময় ধরে এমন অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্বীনি কিংবা দুনিয়াবী জ্ঞানে পরিপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ সকলেই এ সম্পর্কে অবহিত। আগে তাঁরা যেই কাজগুলো করতে সক্ষম হতেন, সেই একই কাজগুলো তাঁরা এখন চাইলেও করতে পারেন না। তাঁরা এই বিষয়ে শুধু আক্ষেপ করে যান, কিন্তু কেন এমন হয় তার কোনো ব্যাখ্যা তাঁদের জানা নেই।” ইবনে হাজার (রহঃ) এই সম্পর্কে লিখেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আগের চেয়ে এখন অনেক দ্রুত দিন পার হয়ে যাচ্ছে। এটি এমন হচ্ছে কারণ, সময় সহ যাবতীয় বিষয়াদির উপর থেকে বরকত উঠে যাচ্ছে। এমন হওয়া আসলে কিয়ামতের আলামতেরই অন্তর্ভুক্ত।”

সময় যতই কিয়ামতের দিকে এগিয়ে যাবে, লোকজনের মধ্য থেকে বরকত ততই উঠে যাবে। এটি এমন এক বাস্তবতা যাকে হেরফের করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আবদুল্লাহ বিন মুবারক (রহঃ) একদা নিম্নোক্ত কবিতার লাইনগুলো লিখেন:

“চলে গেছেন সেসব মানুষ যাদের আমলগুলো ছিলো অনুসরণীয়

তাঁরা সেসব লোক যারা প্রত্যেক পাপ কাজে বাধা দান করতেন,

আর আমি এখন পড়ে আছি সেইসব লোকদের মাঝে যারা একে অপরের ব্যাপারে এতটাই ভ্রান্তিতে আপতিত

যে এক অসৎ ব্যক্তি কেবল আরেক অসৎ ব্যক্তিরই অনুসরণ করে।”

তাঁর পূর্বে আবু দারদা (রাঃ) বলেন, “আগে মানুষ ছিলো কাঁটাবিহীন পাতার ন্যায়। এখন তাঁরা কেবলই পাতাবিহীন কাঁটা।”

আর সবার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেই বলেন, “পরহেযগার ব্যক্তিরা একের পর এক মারা যাবে। এরপর শুধুমাত্র নির্বোধ লোকেরাই বাকি থাকবে।”

কয়েক শতাব্দী পর ইবনে কাসীর (রহঃ) লিখেন যে, যখন ক্রুসেডাররা বায়তুল মাকদিসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, তখন ইসলামী খিলাফত থেকে স্থানীয় আলেমদের প্রতি নির্দেশ আসলো যেন তাঁরা সেখানকার গভর্নরদের ক্রুসেডারদের প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু (শত্রুদের বিরুদ্ধে) প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে অগণিত মুসলিম শাম থেকে ইরাকে পালিয়ে যায়। অল্পকিছু আলেম যারা শাসকদের অনুরোধ করেন যুদ্ধ করার জন্য, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ইবনে আকিল। তিনি জনসাধারণের আচরণবিধি সারসংক্ষেপে তুলে ধরেন এভাবে, “সবচেয়ে আজব যে জিনিসগুলো আমি দেখেছি তার অন্যতম হলো যে, কীভাবে মানুষ তার ধ্বংস হওয়া ঘড়বাড়ি, মৃত্যুশয্যায় শায়িত আত্বীয়স্বজন, ক্ষতিগ্রস্ত অর্থব্যবস্থা নিয়ে আফসোস করে এবং তাদের দুর্দশার জন্য সময় এবং সমসাময়িক লোকজনকে গালমন্দ করে। অথচ তাদেরই চোখের সামনে ইসলামকে ধ্বংস করার প্রয়াস চলছে, মানুষের মধ্য থেকে দ্বীন উঠে যাচ্ছে, সুন্নাহের প্রচলন উঠে যাচ্ছে, বিদআতের আবির্ভাব ঘটছে, মানুষ পাপের মধ্যে ডুবে আছে এবং মানুষ অনর্থক এবং ক্ষতিকর কাজে সময় নষ্ট করছে। অথচ আমি তাদের কাউকেই দেখি না দ্বীনের ব্যাপারে আফসোস করতে বা তার জীবনের অনর্থক নষ্ট হওয়া বছরগুলো নিয়ে দুঃখভরে চোখের পানি ফেলতে। আমি মনে করি এর একমাত্র কারণ হলো যে এসব লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে চিন্তাগ্রস্ত নয়। তারা শুধুমাত্র তাদের দুনিয়াবি লাভ-ক্ষতির চিন্তায় আশংকাগ্রস্ত। সালাফরা ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত।”

তাই লোকেরা উল্টোপথেই রয়ে গেলো। তারা বুঝতে সক্ষম হলো না যে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। নিজের জীবন হারানোর চেয়েও ভয়াবহ হলো ঈমান হারানো। আল্লাহ বলেন, “আর ফিতনা-ফাসাদ তো হত্যার চেয়েও গুরুতর।” [সূরা বাক্বারাহ ২:১৯১] আশ শাওকানি (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “দ্বীনের উপর যেকোনো ধরনের ফিতনা আপতিত হওয়া নিহত হওয়ার চেয়েও গুরুতর, তা যেমন রূপই নেয় না কেন।”

এই ফিতনাগুলো খুবই সূক্ষ্ম, যা কিনা সহানুভূতি-সম্পন্ন লোকদের কাছে থেকেও আসতে পারে। যেমন, অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়ের মতো মুসলিমরাও ট্রাম্পের শাসনামলে নির্যাতিত হওয়ার ব্যাপারে আশংকাগ্রস্ত। এর অর্থ দাঁড়ায় যে তারা আজ সমকামী, লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের সাথে দলা পাকানো অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সমকামীদের ব্যাপারে ইসলামের যে বিধিবিধান, তা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে আপত্তিজনক। এই একই লোকেরা আবার মুসলিমদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। এজন্য কিছু আমেরিকান মুসলিমরা সমকামীদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে নমনীয় করে অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। এমনটি করার মাধ্যমে তারা ওইসব সহানুভূতি-সম্পন্ন লোকদের চেয়েও বড় ফিতনায় আপতিত হয়েছে। জামাল জারাবজো তাঁর আত্মার পরিশুদ্ধি নামক বইয়ে লিখেন, “মুসলিমদের এটি উপলব্ধি করতে হবে যে তাদের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং জীবনধারা বর্তমান বিশ্বের সকলের চেয়ে মৌলিকভাবে ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, যারা পূর্বে কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের অধিকাংশই বর্তমানে তাদের চিন্তাচেতনায়, বিশেষভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে ধর্মনিরপেক্ষ। অন্যদিকে একজন মুসলিমের জীবন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওয়াহী এসেছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কোনো মানুষের মতামত বা আদর্শ কখনোই আল্লাহ এবং তার রাসূলের (সাঃ) বাণীর সমকক্ষ হতে পারবে না।”

তিনি আরো লিখেন, “বাস্তবে হয় এসব অমুসলিমদের উদ্দেশ্য মন্দ, নতুবা তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে যে ওয়াহী এসেছে তা সম্পর্কে বেখবর। সুতরাং আধ্যাত্মিক জ্ঞান, ইবাদাত, নীতি-নৈতিকতা, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এসবের কিছুই তাদের মধ্যে নেই। সুতরাং মুসলিমদের তারা কীই বা দিবে? তারা শুধুমাত্র মুসলিমদের ক্ষতিই করতে পারে। যেহেতু অধিকাংশ অমুসলিমরাই ইসলামকে মোটেই বোঝে না, সুতরাং তারা ইসলামকে তাদের নিজেদের বিকৃত বিশ্বাসের আলোকেই দেখে। এমনকি যাদেরকে ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হয়, তারাও মুসলিমদের থেকে এমন কিছুই চায় যা ইসলাম ত্যাগেরই নামান্তর।”

অবশেষে তিনি লিখেন, “আল্লাহ সেসব লোকদের পরীক্ষা করবেন যারা নিজেদের একনিষ্ঠ এবং ন্যায়পরায়ণ মনে করে। কিন্তু তাই বলে মুসলিমদের আচরণের কোনো পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। এই লোকেরা যতই চেষ্টা করুক না কেন, তাদের মনের উদ্দেশ্য যতই ভালো মনে হোক না কেন, কিংবা তারা যতই চমৎকার স্লোগান দিক না কেন, মুসলিমদেরকে অবশ্যই তাদের দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তারা যত উত্তমভাবেই মুসলিমদের দিকে অগ্রসর হোক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য আসলে ইসলামকে পরিবর্তন করা। বাস্তবে এটি আসলে মুসলিমদেরকে পবিত্রতার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। যদি কেউ দাবি করেও যে তাদের আসল উদ্দেশ্য ভালো এবং তারা অজ্ঞ, সেক্ষেত্রেও শেষ পরিণতির কোনো পরিবর্তন হবে না। তারা মুসলিমদের পবিত্রতার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পথেই কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং শেষ কথা হলো মুসলিমদের অবশ্যই সোজা পথে অটল থাকতে হবে এবং অন্য লোকেরা যদি তাদেরকে অন্য পথে যাওয়ার পরামর্শ দেয় তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।”

এই কাজটি (সরল পথে অটল থাকা) শেষ জমানায় এতই কঠিন হয়ে যাবে যে রাসূল (সাঃ) এ সম্পর্কে বলেন যে, “এমন একটা সময় আসবে যে আমার উম্মত দাজ্জালের আবির্ভাব কামনা করবে।” কেন এমন হবে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “তারা যেসব ফিতনার সম্মুখীন হবে তার জন্য।” এসব ফিতনা খুবই কঠিন প্রকৃতির। লেইনের লেক্সিকন অভিধানে “ফিতনা” শব্দের অর্থ করা হয়েছে “জ্বলন্ত আগুনে পোড়া।” শব্দটির আরো কয়েকটি অনুবাদ করা হয়েছে যেমন, “সোনা কিংবা রূপা গলিয়ে মন্দ থেকে ভালো বের করে আনা”, “এমন একটি দুঃখ-দুর্দশা যার মাধ্যমে একজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করা হয়”, “প্রলোভন”, “পাগলামি, উন্মত্ততা কিংবা অপদেবতা দ্বারা আক্রান্ত”।  আমরা সেই বাস্তবতাকেও পরিবর্তন করতে পারি না যে সময় যতই শেষের দিকে এগিয়ে যাবে ততই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বরকত উঠে যাবে যা এই উন্মত্ততাকে লেলিয়ে দিবে। ফিতনা সম্পর্কে ইবনে হাজার আল আসকালানি (রহঃ) লিখেন, “এসব ফিতনার আবির্ভাব হয় সাহাবীদের সময়েই। এরপরে কিছু কিছু জায়গায় ব্যাপক আকার ধারণ করে অন্যান্য জায়গার তুলনায়। এই ফিতনাগুলো যখন সার্বিকভাবে প্রবল আকার ধারণ করবে, তখনই কিয়ামত আসবে। যদিও এই ফিতনাগুলো সর্বত্র প্রকাশ পাচ্ছে, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় এগুলো অনেক বেশি হারে দেখা যাচ্ছে। যখনই এক প্রজন্মের পরে আরেক প্রজন্ম আসে, তখনই অনেক বিশৃঙ্খলার আবির্ভাব ঘটে।

খেলাফতের দরজা পুনরায় খোলা হয়েছে। কিন্তু এই বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকবে সে পর্যন্ত যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “পৃথিবী অবিচার এবং স্বৈরশাসনে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।” যার পরপরই ইমাম মাহদী এসে একে পরিবর্তন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন (আল্লাহর ইচ্ছায়)। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) রোমান এবং পারস্য সাম্রাজ্যের বড় বড় ভূমি দখল করে চলছিলেন। এরপরেও তাঁর মনে হচ্ছিলো যে ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যে মুমিনদের মনে হবে যেন তাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। সুতরাং তাঁকে যখন ফিতনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বলেন, “একজন ব্যক্তি তার আশেপাশে দেখবে এবং নিজেকে প্রশ্ন করবে যে, এমন কি কোনো জায়গা আছে যেখানে সে সেসব ফিতনা এবং বিপদ-আপদে পতিত হয়নি যা সে বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পড়েছে। কিন্তু সে এমন জায়গা খুঁজে পাবে না।” আপনি যেখানেই বাস করেন না কেন, সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে তা সে কথারই সত্যায়ন করে যে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াহীর মাধ্যমেই এই বাণী এসেছে যে, “এমন কোনো সময় আসবে না যার পরবর্তী সময় এর থেকে আরো খারাপ হবে না।” আমরা এই ঘটনাগুলোকে পরিবর্তন করতে পারি না, কিন্তু নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে পারি যেভাবে সাহাবিরা নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন যখন তাঁদের চোখের সামনে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র সেই জমানার সবচেয়ে বড় বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো। আল্লাহ বলেন,

“মুমিনরা যখন সম্মিলিত বাহিনী দেখলো তখন তারা বললো, ‘এটাতো তা-ই যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) তো সত্য কথাই বলেছেন।’ এতে তাঁদের ঈমান আর আনুগত্যই শুধু বৃদ্ধি পেলো।” [সূরা আহযাব (৩৩):২২]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল মাওদুদি লিখেন, “যখন তাঁরা বিপদের কালো মেঘ দেখতে পেলেন, তখন তাঁরা আল্লাহর ওয়াদার কথা স্মরণ করলেন। আল্লাহ তাঁদেরকে ওয়াদা দেননি যে তাঁরা শুধুমাত্র ঈমান আনলেই তাঁরা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই সমস্ত পৃথিবীর উপর রাজত্ব কায়েম করতে পারবেন এবং ফেরেশতারা এসে তাঁদের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিয়ে যাবেন। বরং আল্লাহর ওয়াদা হলো যে তাঁরা যখনই বড় বড় পরীক্ষা পার করবেন, কঠিন পরিশ্রম এবং ফিতনা পার করবেন এবং অনেক বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করবেন, তখনই আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর দয়া দিয়ে ধন্য করবেন এবং তাঁদেরকে ওয়াদাকৃত সেই সাফল্য দিবেন দুনিয়ায় এবং আখিরাতে।”

তিনি আরো বলেন, “যখন তাঁরা ফিতনা ধেয়ে আসতে দেখলেন, তাঁরা তাঁদের ঈমান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। বরং তাঁরা আরো দৃঢ় হন। আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করার পরিবর্তে তাঁরা তাঁদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠার সাথে পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এখানে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে ঈমান এবং আল্লাহর উপর ভরসা অন্তরের এমন কিছু গুণাবলি যা কিনা আল্লাহর প্রত্যেক হুকুম এবং দাবীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়ে থাকে। জীবনের প্রত্যেক ধাপে আপনি এমন কিছু অবস্থার সম্মুখীন হবেন যেখানে ঈমান আপনার কাছে দাবি রাখবে কিছু কাজ করার, কিছু কাজ থেকে বিরত থাকার, কিংবা আপনার নিজেকে, নিজের সম্পদ, সময়, চাহিদাকে বিসর্জন দেওয়ার। এমন প্রত্যেক পরিস্থিতিতে যারাই আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিচ্যুত হবে, তাদের ঈমান এবং একনিষ্ঠতা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর যারা আল্লাহর আদেশ এবং সময়ের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে, তাদের ঈমান এবং একনিষ্ঠতা আরো শক্তিশালী এবং পরিপূর্ণ হবে।”

তিনি সবশেষে বলেন, “হ্যাঁ আপনি দুটি কালিমা পড়েই মুসলিম এবং মুমিন হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ঈমান কখনো স্থির থাকেনা। এটি হয় বাড়ে নাহয় কমে। একনিষ্ঠতা কিংবা আনুগত্যের কমতি ঘটার কারণে ঈমান কমে যায়। এমনভাবে কমতে থাকলে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়াবে যে এর একটু কমলেই আপনি মুমিন থেকে মুনাফিকে পরিণত হবেন। অন্যদিকে আপনি যতই একনিষ্ঠ, আনুগত্যশীল এবং নিবেদিতপ্রাণ হবেন, আপনি ঈমানে ততই বলীয়ান হতে থাকবেন। একটি পর্যায়ে আপনি সিদ্দিকদের মর্যাদায় উন্নীত হবেন।”

সুতরাং ঈমান আপনাকে যেকোনো পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযুক্ত করবে। যেমনটি রাসূল (সাঃ) বলেন, “ঈমানদারেরা  নমনীয় গাছের মতো যাকে বাতাস ডানে বামে ধাক্কা দেয়, আছড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু ঠিকই এটি পুনরায় সোজা হয়ে যায়। যতক্ষণ না গাছটি শুকিয়ে যায়।”

ঈমান যেকোনো পরিস্থিতিকে ভালোর দিকে নিয়ে যায়। যেমনটি রাসূল (সাঃ) বলেন, “আমি অবাক হই একজন মুমিনের অবস্থা দেখে। প্রত্যেক পরিস্থিতিই তার জন্য কল্যাণকর। যদি তার কোনো মঙ্গল হয়, সে আল্লাহর শুকরিয়া করে। আর যদি তার কোনো অমঙ্গল হয়, তবে সে ধৈর্যধারণ করে যা তার জন্য মঙ্গলজনক। এমনটি ঈমানদার ছাড়া কারো ক্ষেত্রেই হয় না।”

আর যেকোনো পরিস্থিতেই ঈমান বজায় রাখতে হয়। যেমনটি রাসূল (সাঃ) আনসারদের উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমরা আমাকে বাইয়াত দাও যে তোমরা আমার কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে অলস কিংবা উদ্যম উভয় অবস্থায়। এবং তোমরা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করবে ভালো কিংবা মন্দ সর্বাবস্থায়। এবং তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং তোমরা মানুষের তিরস্কার এবং বাধা উপেক্ষা করে আল্লাহর ব্যাপারে সত্য কথা বলবে। যদি এমনটি করতে পারো, জান্নাত তোমাদেরই জন্য।“

লেখক: তারিক্ব মেহান্না

বৃহস্পতিবার, ২৪শে সফর, ১৪৩৮ হিজরি (২৪শে নভেম্বর, ২০১৬)

ম্যারিয়ন সিএমইউ কারাগার


উৎস: কালামুল্লাহ ডট কম (মূল আর্টিকেল লিংক)

অনুবাদক: মিনহাজ মুক্তাদির, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি

অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive