ফাতিমার ছোটবেলার বান্ধবী সামিরা। স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ, ভার্সিটি সব স্থানেই একসাথেই পড়ালেখা করেছে তারা। ভালো সম্পর্কের সূত্রেই সামিরা ছোটবেলা থেকেই ফাতিমার বাসায় আসতো। কিন্তু ফাতিমার বিয়ের পরে তাদের তেমন আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তবে নিয়মিত ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতে না পারলেও ফেসবুকে তার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে ফাতিমা। কিন্তু ফাতিমা কিছুদিন ধরে লক্ষ করছে যে সামিরা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। ফেসবুকে তার সব পোস্টেই যেন পরোক্ষভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ দেখা যায়। সামিরার এরূপ পদস্খলন দেখে একদিন

ফাতিমা ম্যাসেজে বললো,

IIRT Arabic Intensive

-“সামিরা, কেমন আছিস?”

-“হ্যাঁ, ভালো আছি। আমি সবসময় ভালোই থাকি এবং থাকবো।”

-“এটা কেমন কথা, সামিরা? মানুষকে তো আল্লাহ যেকোনো সময়ই অসুস্থতা দিতে পারেন! এভাবে বলা কি ঠিক হলো?”

-“আরে, ওসব ধর্মীয় কথা বাদ দে তো!”

সামিরার এই অবস্থা দেখে ফাতিমা আর কথা বাড়ালো না। বাসায় আসলে বিস্তারিত আলোচনা করবে, এই আশায় বললো, “আচ্ছা, ঠিক আছে। ওসব কথা বাদ! আমার বাসায় আসিস। তোর দাওয়াত থাকলো।”

সামিরা বললো, “আচ্ছা, ঠিক আছে।”

কিছুদিন পর সামিরা ফাতিমার বাসায় বেড়াতে এলে ফাতিমা তাকে বেডরুমে নিয়ে বসালো। সামনে কিছু নাস্তা দিয়ে ফাতিমা জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছিস?”

সামিরা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, ভালো আছি।”

-“তোর বাবা মা কেমন আছে?”

-“এই তো ভালোই।”

-“তারপর চাকরীর কী খবর?”

-“ছেড়ে দিবো ভাবছি!”

-“কেন?”

-“আছে। সামনে একটি প্ল্যান আছে।”

-“চাকরী বাদ দিয়ে আজেবাজে ব্লগ-ফ্লগ ঘোরাঘুরি করিস নাকি, হুম?”

-“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

-“না মানে, ফেসবুকে তোর লেখাগুলো আমি নিয়মিত পড়ি তো। তোর এরকম চিন্তাধারার কারণ জানার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম।” প্রশ্ন করলো ফাতিমা।

সামিরা উত্তর দিলো, “আমি জ্ঞান অর্জন করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছি, সেটা প্রচার করতেই পারি। তো তুই তো দেখি ইদানীং ভালোই ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজা শুরু করেছিস! ফেসবুকে পোস্টও দিচ্ছিস দেখলাম।”

ফাতিমা বললো, “এগুলো তো কুরআনের নিদর্শন। আমিও জ্ঞান অর্জন করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছি, সেগুলো ইসলাম প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রচার করতেই পারি। কেন? আমি যা লিখেছি, তার কোনোকিছু কি তোর কাছে ভুল মনে হয়েছে?”

সামিরা উত্তর দিলো, “না! ভুল মনে হয়নি। তবে তুই যেটাকে নিদর্শন হিসেবে প্রচার করেছিস, সেটি আসলে কোনো নিদর্শনই নয়। কোরানে ভ্রূণবিদ্যার ব্যাপারে ফেসবুকে তোর লেখা দেখলাম! কিন্তু কোরানের এই ভ্রূণবিদ্যা কোনো নিদর্শন নয়। মোহাম্মদ যখন এগুলো বলেছে, তারও অনেক আগে থেকেই এসব জ্ঞান গ্রীকদের কাছে ছিলো। সুতরাং, মোহাম্মদ সেখান থেকে এগুলো নকল করেছে। তাই এখানে নিদর্শনের কিছু নাই!”

ফাতিমা বললো, “আচ্ছা, তাহলে তুই মেনে নিয়েছিস যে কুরআনের ভ্রূণবিদ্যা সঠিক। কিন্তু তোর বক্তব্য হলো, মুহাম্মাদ ﷺ এসব বিবরণ গ্রীকদের থেকে নকল করেছেন। তাই তো?”

সামিরা উত্তর দিলো, “হুম! হতে পারে!”

ফাতিমা বললো, “আচ্ছা সামিরা! মুহাম্মাদ ﷺ তো গ্রীক ভাষা পড়তে বা লিখতে জানতেন না। তাহলে কীভাবে তিনি তাদের বিদ্যা অর্জন করে সেগুলো কুর’আনে বর্ণনা করবেন?”

সামিরা বললো, “হা হা! আমি তো তোকে যথেষ্ট জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী ভাবতাম। কিন্তু এই সাধারণ বিষয় তুই জানিস না? এটা কিন্তু আমি তোর কাছ থেকে আশা করিনি। আচ্ছা, শোন তাহলে। মোহাম্মদের এক সাথী ছিলো, তার নাম হলো হারিস বিন কালাদাহ। সে জন্মগ্রহণ করে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে তায়েফের বনু সাকিফ গোত্রে। সে মেডিসিন বিষয়ে পড়ালেখা করেছে দক্ষিণ পারস্যের জুনদিশাপুরের একটি মেডিকেল স্কুলে। সেখানেই সে অ্যারিস্টটল, হিপোক্রিটাস ও গ্যালেনের দেওয়া ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছে। পড়াশোনা শেষে সে আরবে চলে আসে, এবং ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর মোহাম্মদ তার কাছ থেকে ভ্রূণবিদ্যা আর যত চিকিৎসা আছে, সবকিছু শিখে নিয়ে তারপর কোরানে বর্ণনা করেছে। সুতরাং, কোরানের ভ্রূণবিদ্যা গ্রীকদের থেকেই নকল করা।[১] তাই এতে বৈজ্ঞানিক নিদর্শনের কিছু নেই। হা হা!”

ফাতিমা বললো, “হুম! সামিরা, আমিও যে এই বিষয়ে জানতাম না তেমনটি নয়। তুই ব্যপারটি বিস্তারিত জেনে বলেছিস নাকি অন্যের কাছ থেকে শুনেই প্রচার করে বেড়াচ্ছিস, সেটা জানার জন্যই জিজ্ঞাসা করলাম। মূলত তুই যে ইতিহাস আমাকে বললি, সেই ইতিহাসে কিছু ত্রুটি আছে।”

সামিরা জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন ত্রুটি?”

ফাতিমা বললো, “ত্রুটিগুলো আমি তোকে বলছি। কিন্তু এর আগে তোকে বুঝতে হবে ‘রিজাল শাস্ত্র’ কী জিনিস। রিজাল শাস্ত্ৰ মুসলিমদের আবিষ্কৃত হাদীসের জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখার নাম। এর মাধ্যমে হাদীস বর্ণনাকারীগণের নাম ও পরিচয় ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়, তাই একে ‘আসমাউর রিজাল’ বলা হয়। একটি হাদীসে দু’টি অংশ থাকে- সনদ ও মতন। আর সনদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সনদে উল্লিখিত সাহাবা, তাবিঈ তথা সকল বর্ণনাকারীর সার্বিক অবস্থা জানা যায়। এ কারণে একে হাদীস শাস্ত্রের অর্ধেক বলা হয়ে থাকে। এছাড়া ইলমে হাদীসের যত শাখা-প্ৰশাখা রয়েছে, তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো রিজাল শাস্ত্র। এবার আমি তোকে তোর বলা কথার ত্রুটিগুলো বলছি।”

এই মুহূর্তে রুমে আদনানের বোন নাবিলা এসে বললো, “ভাবী, কার সাথে কথা বলছো? এই আপুটি কে?”

ফাতিমা বললো, “নাবিলা, এ সামিরা। আমার ক্লাসমেট। আর, সামিরা, এ নাবিলা; ও আমার ননদ।”

নাবিলা বললো, “ও! আপু কেমন আছেন?”

সামিরা বললো, “হ্যাঁ, নাবিলা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

নাবিলা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। তো, তোমরা কী নিয়ে কথা বলছো?”

ফাতিমা বললো, “এই তো কুরআনের ভ্রূণবিদ্যার বিরুদ্ধে নকলিকরণের অভিযোগ করেছে তোমার আপু। তাই আমি একটু বিশ্লেষণ করছি।”

নাবিলা বললো, “ও! তাহলে আমিও একটু শুনি।”

এই বলে নাবিলা, ফাতিমা ও সামিরার সামনে খাটের উপর বসে পড়লো। ফাতিমা আর সামিরাও নড়েচড়ে নাবিলাকে একটু বসার জায়গা করে দিলো।

ফাতিমা একটু নড়েচড়ে বসে বলা শুরু করলো, “সামিরা, প্রথমত তুই বলেছিস যে ‘হারিস বিন কালাদাহ’ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথী বা সাহাবি ছিলেন। এখন এই রিজাল শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা অনুসন্ধান করবো যে, সত্যিই তিনি সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কি না। রিজাল শাস্ত্রের বিখ্যাত বই উসদুল গাবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবা’গ্রন্থটি লিখেছেন আলি ইবনুল আসির।[২] তিনি এই কিতাবে হারিস বিন কালাদাহ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লেখেন, ‘তিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং তিনি সাহাবি নাকি সাহাবি নন-এই বিষয়ে মতভেদ আছে।[৩] ইবনে কিফতিও মন্তব্য করেছেন যে, তিনি সাহাবি ছিলেন কি ছিলেন না এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ সাহাবা তাদেরই বলা হয় যারা আল্লাহর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করেছে এবং ঈমান এনেছে, মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছে। এই সূত্রে তিনি সাহাবা নন।[৪] অনেকের মতে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি অর্থাৎ তিনি মুসলিম নন।’[৫] বুঝলি?”

সামিরা বললো, “তাদের এই ফতোয়ার পক্ষে প্রমাণ কী?”

ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “তুই আবার দলিলের খোঁজও করিস? হা হা। আচ্ছা, এই কথার প্রমাণ একটি হাদীস থেকে পাওয়া যায়। হাদীসটিতে আছে, বিদায় হজ্জের সময় সা’দ (রাঃ) অসুস্থ ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে দেখতে গেলে সা’দ (রাঃ) বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মনে হয় এই অসুস্থতায় আমার মৃত্যু ঘটবে।’ তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘আমি এই আশা করি যে আল্লাহ্‌ তোমাকে সুস্থতা দান করবেন, এবং এর দ্বারা কিছু লোকের উপকার ও কিছু লোকের ক্ষতি পৌঁছাবেন।’ তখন তিনি হারিস বিন কালাদাহকে বলেন সা’দকে (রাঃ) চিকিৎসা করে সুস্থ করার জন্য। উত্তরে হারিস বললো- ‘ওয়াল্লাহি, আমি আশা করি যে, সে সুস্থ হয়ে যাবে।’ তারপরে হারিস বললেন, ‘তোমার কাছে কি আজওয়া খেজুর আছে?’ সা’দ (রাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন হারিস খেজুর, হিলবাহ নামের এক ধরনের হলুদ শস্য ও চর্বি দিয়ে একধরনের ঔষধ তৈরি করে তাকে (রাঃ) খাওয়ায়। তখন, সে এমনভাবে সুস্থ হয়ে যায়, যেন কখনো অসুস্থই ছিলো না।’[৬] এই হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেন ইবনে আবি হাতেম। তাঁর মন্তব্য ইবনে হাজার আসকালানি তাঁর রিজাল শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ আল-ইসবাহ ফি তামিয়্যিজ আল-সাহাবা গ্রন্থে বর্ণনা করেন।[৭] তিনি উল্লেখ করেন, ‘ইবনে হাতেম বলেন, ‘আল-হারিস মুসলিম হিসেবে গৃহীত নয়। এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে অমুসলিম কোনো চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়া বৈধ।’[৮] তাহলে এ থেকে তো প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে, হারিস বিন কালাদা মুসলিম কিংবা সাহাবা ছিলেন না।”

সামিরা কোনো কথা বলছে না। চুপ করে শুনছে। নাবিলা উঠে গিয়ে দুজনের জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে এসে বললো, “আপু এগুলো খান, আর গল্প করেন।”

সামিরা খুশি হয়ে বললো, “আচ্ছা, ঠিকাছে। ফাতিমা, তুই বল। আমি শুনছি।”

ফাতিমা বললো, “এখন, হারিস বিন কালাদাহ মেডিসিন বিষয়ে দক্ষিণ পারস্যের জুনদিশাপুরের মেডিকেল স্কুলে পড়ালেখা করেছেন কি না, সেটা খণ্ডন করি। অনেক ইতিহাসবিদ জুনদিশাপুরে মেডিকেল স্কুলের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। এমন একজন হলেন David C. Lindberg । তিনি বলেন, ‘জুনদিশাপুরে মেডিকেল স্কুলের অস্তিত্বের পক্ষে আমাদের কাছে কোনো যুক্তিযুক্ত বা সন্তোষজনক প্রমাণ নেই।’[৯] আবার, ইতিহাসে ওই সময়ে এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন মেডিসিন বিষয়ক ঐতিহাসিক Roy Porter । তিনি বলেন, ‘জুনদিশাপুরে মেডিকেল অ্যাকাডেমির অস্তিত্বের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।’[১০] আরো একজন ইতিহাসবিদ জুনদিশাপুরে মেডিকেল অ্যাকাডেমির অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করে বলেন, ‘সেখানে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে সম্ভবত কোনো হাসপাতাল থাকতে পারে। কিন্তু কোনো মেডিকেল স্কুলের অস্তিত্ব ছিলো না। কারণ আমরা দেখি, ৮ম শতাব্দীর প্রথম দিকে উমাইয়্যাহ খিলাফতের সময় জুনদিশাপুরে মেডিকেল কলেজ খ্যাতি অর্জন করে।’[১১] সুতরাং, ওই সময়ে জুনদিশাপুরে এমন কোনো মেডিকেল স্কুল ছিলো না যে সেখান থেকে হারিস বিন কালাদাহ ভ্রূণবিদ্যা শিখে এসে রাসূলুল্লাহকে ﷺ শিখাবে।”

ফাতিমাকে থামিয়ে সামিরা বললো, “কিন্তু আমি যে উইকিপিডিয়াতে দেখলাম, হারিস বিন কালাদাহ মুসলিম ছিলেন এবং মোহাম্মদের সাথী ছিলেন! এবং তিনি জুনদিশাপুরের মেডিকেল স্কুলে পড়েছেন।”

ফাতিমা বললো, “দ্যাখ, সামিরা! ইসলামের সব বিষয়ে যে তুই ইন্টারনেট থেকে সঠিক তথ্য পাবি – এমন তো নয়। ইসলামের প্রত্যেক বিষয় যাচাই করার জন্য আলাদা আলাদা শাস্ত্র আছে। যারা জানে, তাদের কাছ থেকে তোকে এগুলো প্রমাণসহ জেনে নিতে হবে। এবার, তোকে তোর অজানা একটি তথ্য দিচ্ছি! এই বিষয়ে সর্বপ্রথম অভিযোগ তোলা হয় ১৯৯০ সালে খ্রিষ্টান মিশনারিদের পক্ষ থেকে। তারপর থেকে সবাই এটা বঙ্গানুবাদ করেছে, কিন্তু সত্য-মিথ্যা কেউ যাচাই করেনি বা করলেও ইসলামোফোবিয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মিথ্যা অপপ্রচার করেছে। আর জুনদিশাপুরে মেডিকেল স্কুলের অনুপস্থিতির ব্যাপারে তো ঐতিহাসিকদের মতই উল্লেখ করলাম। তাঁরা তো কেউ মুসলিম নন যে, তুই পক্ষপাতিতার অভিযোগ তুলবি।”

এটুকু বলে ফাতিমা ট্রে থেকে কিছু আঙুর নিয়ে খেতে খেতে বললো, “তর্কের খাতিরে যদি তোর কথা মেনেও নেই যে, হারিস বিন কালাদাহ জুনদিশাপুরে ভ্রূণবিদ্যার ব্যাপারে জেনেছে, তবুও কিন্তু কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে কুরআনের ভ্রূণবিদ্যা তার থেকে নকল করা। কারণ, কুর’আনে ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে সূরা মু’মিনুনের ১৩-১৪ নং আয়াতে এবং এই আয়াত দুটি নাযিল হয় রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কায় থাকাকালীন।[১২] অর্থাৎ, মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের আগে। উল্টোদিকে, তায়েফের বনু সাকিফ গোত্রের বাসিন্দা হলো হারিস বিন কালাদাহ। এই তায়েফ ইসলামিক ইতিহাসের পাতায় আসে হুনাইনের যুদ্ধের পরে তায়েফ অবরোধের সময়। এই অবরোধ ২০ দিন ধরে অব্যাহত ছিলো।[১৩] এসময় আবু বাকরাহ সহ কয়েজকজন দাসকে রাসূলুল্লাহ মুক্ত করে দেন। এই আবু বাকরাহ ছিলেন হারিস বিন কালাদার ক্রীতদাস। আর এই ঘটনা ঘটে মক্কা বিজয়েরও পরে এবং সেটা মদীনায় হিজরতের অনেক পরে।[১৪] এর আগে কোনো সময় হারিস বিন কালাদাহ-এর ব্যাপারে কোনো কিছু ইসলামের ইতিহাসে নেই বা আল্লাহর রাসূলের সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে – এমন প্রমাণ নেই। তাই ভ্রূণবিদ্যার জ্ঞান হারিস বিন কালাদার কাছ থেকে নকল করার অভিযোগ ভিত্তিহীন মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। আমার মনে হয় তুই বুঝতে পেরেছিস যে তুই অপপ্রচারের শিকার।”

সামিরা বললো, “আচ্ছা মেনে নিলাম যে মোহাম্মদ হারিস বিন কালাদা থেকে ভ্রূণবিদ্যার জ্ঞান নকল করেনি। কিন্তু ভ্রূণবিদ্যার এই জ্ঞান তো অ্যারিস্টটল, হিপোক্রেটাস এবং বিশেষ করে গ্যালেনেরও ছিলো। তাই কোরানিক ভ্রূণবিদ্যা কোনো বৈজ্ঞানিক নিদর্শন নয়। এটা তো ওই সময়ের বিজ্ঞানীরাও জানতেন।”

ফাতিমা বললো, “সামিরা, তুই ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখিস তা আমি জানি না। আমার মনে হয় তোর এই বিষয়ে জ্ঞান কম। তা নাহলে তুই গ্রীকদের ভ্রূণবিদ্যার জ্ঞান সঠিক বলতি না। ভ্রূণবিদ্যা এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে মানুষ অনেক প্রাচীনকাল থেকেই গবেষণা করে যাচ্ছে। কারণ, মানুষ কীভাবে তৈরি হয়-এই বিষয়ে প্রত্যেক মানুষেরই আগ্রহ থাকে। এই আগ্রহ থেকেই গবেষণা করতে করতে ভ্রূণবিদ্যা এখন বিজ্ঞানের একটি বৃহৎ শাখায় পরিণত হয়েছে। তোকে জানানোর জন্য আমি এখন কুরআন নাযিলের আগে ভ্রূণবিদ্যা বিষয়ক যত মতামত ছিলো সেগুলো একটু সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করছি। নাবিলা আমার ডায়েরিটা মনে হয় ড্রয়িং রুমে সোফার উপরে আছে। একটু নিয়ে এসো তো।”

নাবিলা উঠে গিয়ে অনেক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো, “পাচ্ছি না তো, ভাবী!”

সামিরা টিটকারি মেরে বললো, “এই সামান্য জিনিস বলতে তোর ডায়েরি লাগে? এজন্যই তোদেরকে আমরা মাথামোটা বলি!”

“এত কিছু মুখস্থ রাখা তো সহজ বিষয় না। তুই অভিযোগ করেছিস। আমি সেটা খণ্ডন করছি। আমাকে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করতে হচ্ছে। কিন্তু তুই তো কোনো প্রমাণ দিয়ে কথা বলিসনি। এজন্য তোর বেশি কিছু মুখস্থ থাকার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু আমার বলতে ডায়েরিটি লাগবে। কারণ, আমি ভ্রুণবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করার সময় সবকিছু সেখানে লিখে রেখেছিলাম।” বলে ডায়েরিটি খুঁজতে উঠে গেলো ফাতিমা।

কিছুক্ষণ পর ফাতিমা ডায়েরিটি হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো। নাবিলার তো মাথায় হাত। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলো, “এটা কোথায় পেলে?”

-“কেন? সোফায়।”

-“কই? আমি তো পেলাম না!”

-“পাশে পড়ে গিয়েছিলো।”

-“ও! এজন্যই পাইনি।”

-“আরেকটু ভালো করে খুঁজলে পেতে মনে হয়!”

-“স্যরি।” বলে মাথা নিচু করে থাকলো নাবিলা।

-“আরেহ! স্যরি বলার কিছু নেই। ইটস ওকে।” বলে আবার সামিরার পাশে গিয়ে বসলো ফাতিমা।

তারপর ডায়েরির দিকে তাকিয়ে ফাতিমা বললো, “তাহলে প্রথমে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ ‘Garbha Upanishad’[১৫] এর কথা বলি। এই বইয়ে ভ্রূণবিদ্যার ব্যাপারে বলা আছে, ‘গর্ভধারণের উপযুক্ত সময়ে সহবাস করার কারণে পুরুষের বীজ বা শুক্রাণু ও নারীদের রজঃস্রাবের রক্তের সম্মিলিত হবার ফলে একটি ভ্রূণ অস্তিত্বে আসে। একদিন পরে এটি একটি মিশ্রিত বস্তুতে পরিণত হয়। সাতদিন বা এক সপ্তাহ পরে এটি একটি বুদবুদে পরিণত হয়। তার দুই সপ্তাহ পরে বা চৌদ্দ দিন পরে অর্থাৎ ২১তম দিনে গোলাকার বস্তু বা পিণ্ডে পরিণত হয়। একমাসে বা ৪ সপ্তাহে এটি কঠিন হয়ে একটি শক্ত পিণ্ডে পরিণত হয়। দ্বিতীয় মাসে বা ৮ সপ্তাহে মস্তিষ্ক তৈরি হয়। এবং তৃতীয় মাসে বা ১২ সপ্তাহে বাহু অর্থাৎ হাত-পা তৈরি সম্পন্ন হয়। চতুর্থ মাসে পেট ও শ্রোণীদেশ তৈরি সম্পন্ন হয়। পঞ্চম মাসে মেরুদণ্ড তৈরি সম্পন্ন হয়। ছয় মাসে নাক-চক্ষু-কান তৈরি সম্পন্ন হয়। সপ্তম মাসে ভ্রূণে জীবন সঞ্চারণ করা হয়। আট মাসে এই ভ্রূণ সম্পূর্ণ হয়, মানে সবদিক থেকে আরকি।’[১৬] কী বুঝলি?”

“কী বুঝবো? প্রথমে কিছু ভুল আছে।” বললো সামিরা।

ফাতিমা বললো, “শুধু প্রথমে না। অনেক জায়গায় ভুল আছে। প্রথম যে ভুল সেটি হলো, মানুষ সৃষ্টিতে রজঃস্রাবের রক্তের অংশগ্রহণ। আসলে কুরআনের আগে সব গ্রন্থেরই এমন ধারণা ছিলো যে, শুক্রাণু এবং রজঃস্রাবের রক্তের মিশ্রণের ফলে মানুষ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আসলে এই ধারণা ভুল। তারপরে, বুদবুদ, গোল পিণ্ড এগুলো ভ্রূণের বিবরণের জন্য কোনো গৃহীত বৈশিষ্ট্য নয়। তারপরের ভুল হলো, একটি ভ্রূণের মাথার অস্থি নির্দিষ্ট আকৃতিতে আসে ২০ সপ্তাহে।[১৭] তারপরেও ব্রেইনের বৃদ্ধি চলতে থাকে। কিন্তু উপনিষদে বলা আছে ৮ সপ্তাহে মস্তিষ্ক তৈরি হয়। সুতরাং, এই ধারণাও ভুল। তারপরের ভুল হলো, উপনিষদে বলা আছে ৭ মাস বয়সে ভ্রূণে জীবন সঞ্চার করা হয়। কিন্তু এই তথ্যও ভুল। কারণ, মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে যে শিশু জন্মগ্রহণ করে কোনো সমস্যা ছাড়াই বেঁচে গিয়েছে তার নাম হলো, James Elgin Gill। ওর জন্ম কানাডার ওটাওয়া-তে ১৯৮৭ সালের ২০শে মে। জন্মের সময় তার বয়স ছিলো ২১ সপ্তাহ ৫ দিন অর্থাৎ প্রায় ৫.৫ মাস।[১৮] তাহলে ৭ মাসেই যদি ভ্রূণে প্রাণ আসতো, তাহলে এই বাচ্চা বেঁচে যেতো না। আবার, উপনিষদে বলা হয়েছে, ৮ মাসে ভ্রূণ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ভ্রূণবিদ্যা বলে, একটি ভ্রূণের ফুসফুস পরিপূর্ণ হয় ৯ মাস শেষ হলে।[১৯] তাহলে দেখা যাচ্ছে, এসব ক্ষেত্রেও উপনিষদ ভুল তথ্য দেয়।”

“হুম।” বলে হাসিমুখে মাথা নাড়লো নাবিলা।

ফাতিমা বলতে থাকলো, “এবার ইংরেজিতে উপনিষদ থেকে কিছু পড়ে শোনাচ্ছি। মনোযোগ দিয়ে শোন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘If the potency of both the father and the mother are equal with no pulling force in either, it becomes an intersex. It is born as a blind or as a deaf or dumb or short or with other deficiency due to any mental confusion during the period of pregnancy. If the male reproductive fluid is split because of the air moving around in the body, twins are born.’[২০] অর্থাৎ, পিতার বীর্যের শক্তি যদি মাতার শক্তির সমান হয়, তাহলে সন্তান হিজড়া তৈরি হয়। আর গর্ভধারণের সময় যদি একজন মা কোনো ধরনের মানসিক দুশ্চিন্তায় ভোগে, তাহলে সন্তান অন্ধ, বধির ইত্যাদি হিসেবে জন্ম নেয়। আর যদি শরীরে বাতাস চলাচল করার কারণে বীর্য দুই ভাগ হয়ে যায়, তাহলে জমজ সন্তান জন্মায়। সামিরা, এই বক্তব্য মনে হয় আমার আর খণ্ডন করা লাগবে না। তুই নিজেই বুঝেছিস যে বিজ্ঞান অনুযায়ী এই কথাগুলো কতটুকু অযৌক্তিক।”[২১]

এতটুকু বলে মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ফাতিমা। ফাতিমাকে বিরক্তির সুরে সামিরা বললো, “কিন্তু আমি তো ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে ভারতীয়দের উপনিষদের কিছু তোর কাছে জিজ্ঞাসা করিনি। আমি তো বলেছি গ্রীকদের কথা!”

ফাতিমা একনজরে ডায়েরির একটি পেজে চোখ বুলিয়ে বলা শুরু করলো, “হ্যাঁ, এবার গ্রীকদের ধারণা তোকে বলছি। গ্রীকদের মধ্যে ভ্রূণবিদ্যার ব্যাপারে মন্তব্য ও গবেষণাকারীদের মধ্যে হিপোক্রিটাস, অ্যারিস্টটল ও গ্যালেনের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে হিপোক্রিটাস বলেন, ‘বীর্য এমন একটি জিনিস, যেটি পিতা ও মাতার সমস্ত দেহ থেকে আসে। যখন ভ্রূণ হয়, তখন এটি মায়ের মেন্সট্রুয়াল ব্লাডের মাধ্যমে পুষ্টি পেয়ে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এজন্য সন্তান ধারণের পরে মায়েদের মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে এই মিশ্রণ থেকে মাংস ও নাভী তৈরি হয়।’[২২] হিপোক্রিটাসের প্রথম ভুল হলো, বীর্য কখনোই সম্পূর্ণ দেহ থেকে আসে না। এবং দ্বিতীয় ভুল হলো, ভ্রূণ মেন্সট্রুয়াল ব্লাডের মাধ্যমে পুষ্টি পায় না। আর এই পুষ্টির কারণে মেন্সট্রুয়েশান বন্ধও হয় না। নারীদের মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ হওয়ার কারণ হলো, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলে জাইগোট হবার পরে বিভিন্ন স্টেজ অতিক্রম করে। তখন উৎপন্ন ট্রপোব্লাস্ট কোষ থেকে হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন বা hcG নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ল্যুটিনাইজিং হরমোন বা LH নামক আরেকটি হরমোন নিঃসৃত করে। এই ল্যুটিনাইজিং হরমোন বা LH ডিম্বাশয়ের মধ্যে কর্পাস ল্যুটিয়্যামকে নষ্ট হতে দেয় না। তখন কর্পাস ল্যুটিয়্যাম থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই অতিরিক্ত হরমোনের কারণেই যখন কেউ গর্ভবতী হয়, তখন তার জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াম বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ হয়ে যায়।[২৩] তাহলে তুই বুঝতেই পারছিস যে, হিপোক্রিটাসের ধারণাতেও প্রচুর ভুল ছিলো।”

“নাবিলা ফ্রিজ থেকে একটু ঠাণ্ডা পানি আনো তো।” বলে সামনে রাখা একটি বিস্কুট নিয়ে খাওয়া শুরু করলো ফাতিমা। নাবিলা উঠে গেলো পানি আনার জন্য। ফ্রিজ থেকে পানি এনে দিয়ে এবার ফাতিমার পাশে গিয়ে বসলো নাবিলা। বললো, “নাও, পানি খাও।”

ঢকঢক করে হাফ লিটার পানি একাই শেষ করে দিলো ফাতিমা। অনেকক্ষণ কথা বলায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে মনে হয়।

পানি খেয়ে ফাতিমা ডায়েরি থেকে আরেকটি পয়েন্ট দেখে নিয়ে বললো, “বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেন, ‘একটি ভ্রূণ তৈরি হয় মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল ব্লাড দিয়ে, যখন এটি ছেলেদের বীর্য দ্বারা সক্রিয় হয়।’[২৪] অ্যারিস্টটলও একই ভুল ধারণা পোষণ করতেন যে, ভ্রূণ তৈরি হতে মেন্সট্রুয়াল ব্লাড লাগে। এছাড়াও অন্যান্য ভুল তো রয়েছেই। সেগুলো আমি উল্লেখ করলাম না। তাহলে বোঝা গেলো যে, অ্যারিস্টটলও ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে প্রচুর ভুল ধারণা পোষণ করতেন। এবার তোকে গ্যালেনের ধারণা বলি। গ্যালেনের ধারণা অবশ্য হিপোক্রিটাস, অ্যারিস্টটল ও অন্যান্যদের থেকে উন্নত ছিলো। ক্লডিয়াস গ্যালেন বলেন, ‘অ্যারিস্টটল যেমন বলেছিলেন যে মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল ব্লাড বীর্য দ্বারা সক্রিয় হয়ে ভ্রূণ তৈরি হয়, প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি তেমন নয়। প্রকৃতপক্ষে ভ্রূণ তৈরি হয় ২টি বীর্য এবং মেন্সট্রুয়াল ব্লাডের মিশ্রণে। তারপরে এটি রক্ত দিয়ে পরিপূর্ণ হয়। তখনও হৃদপিণ্ড, স্নায়ু এবং যকৃত পরিপূর্ণ আকৃতিতে থাকে না। তারপরে হাড়ের উপরে মাংস তৈরি হয়। এর পরে প্রকৃতি তার হাত ও পা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করে।’[২৫] সামিরা দ্যাখ, গ্যালেনও বলেছেন যে, মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল ব্লাড এবং পুরুষের ২টি বীর্য মিশ্রিত হয়ে ভ্রূণ তৈরি হয়। আর উনি ২টি বীর্য বলতে কী বুঝিয়েছেন তা আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন। সুতরাং, গ্যালেনের ধারণাতেও ভুল ছিলো। এবার ইয়াহুদিদের ধারণা শুনবি?”

“বল, শুনি।” সামিরা উত্তর দিলো।

ফাতিমা বললো, “ইয়াহুদীদের Talmud অনুযায়ী, ‘একটি ভ্রূণের হাড়, রগ বা টেনডন, নখ, স্নায়ু এবং চোখের সাদা অংশ তৈরি হয় পুরুষের অংশ থেকে; তাই এগুলো সাদা রঙের। আর চামড়া, মাংস, রক্ত এবং চুল তৈরি হয় মায়ের অংশ থেকে এবং এগুলো হয় লাল।’[২৬] আধুনিক জীনতত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের প্রত্যেকটি কোষ কেমন হবে সেই তথ্য কোষের নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোমে জিনের মধ্যে থাকে। এরপর জিনের প্রকটতা ও প্রচ্ছন্নতা অনুযায়ী একটি কোষ পিতা অথবা মাতার আকৃতি পায় এবং অনেকগুলো কোষ মিলেই একটি অঙ্গ তৈরি হয়।[২৭] সুতরাং, সবসময়ই যে একটি অঙ্গ পিতার মতো আর অন্য অঙ্গটি মাতার মতো হবে, এই ধারণা ভুল। সুতরাং আমাদের মাঝে আলোচনাতে একটি জিনিস স্পষ্ট হবার কথা যে, কুরআনের আগে যত গ্রন্থেই ভ্রূণবিদ্যার ব্যাপারে তথ্য আছে, সবগুলো বইতেই এই ভ্রান্ত ধারণা আছে যে সন্তান তৈরি হয় পুরুষের বীর্য এবং নারীদের মেন্সট্রুয়াল ব্লাডের মিশ্রণে। কিন্তু মূলত সন্তান তৈরি হয় পুরুষের শুক্রাণু ও নারীদের ডিম্বাণুর মিশ্রণে। এছাড়াও অন্যান্য ভুলত্রুটি তো আছেই। কিন্তু কুরআন ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের সঠিক তথ্য দেয়। পবিত্র কুর’আনে সূরা মু’মিনুনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তা’আলা নুতফাহকে বা শুক্রাণু ও ডিম্বাণুকে জরায়ুতে স্থাপন করেন। তারপরে একে অর্থাৎ জাইগোটকে একটি আলাকাহতে বা জোঁকের মতো বস্তুতে পরিণত করেন। তারপর এই আলাকাহকে মুদ্গাহতে বা চর্বিত মাংসপিণ্ডে পরিণত করেন। এরপর এই মুদগাহ থেকে হাড় তৈরি করেন এবং অতঃপর এই হাড়কে মাংস দিয়ে আবৃত করে দেন। অতঃপর তাকে নতুন এক সৃষ্টিরূপে বের করে আনেন। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়।’ আধুনিক ভ্রূণবিদ্যা অনুযায়ী কুর’আনে বর্ণিত এই পর্যায়গুলোর সবগুলোই সঠিক।”[২৮]

সামিরার প্রফুল্ল বদনটি আর অবশিষ্ট নেই। মুখ কালো করে বসে আছে। একটু থেমে তাই ফাতিমা আবার বলা শুরু করলো, “তাহলে দেখা যাচ্ছে কুরআনের পূর্ববর্তী সমস্ত জ্ঞানেই ত্রুটি ছিলো। কিন্তু কুরআনই ভ্রূণবিদ্যা বর্ণনা করতে গিয়ে কোনো ভুল করেনি। প্রাচীন গ্রীকদের ধারণা থেকে কুরআনের ধারণা উন্নত এবং গ্রহণযোগ্য। তাহলে কুরআন যদি তাদের থেকে নকলই করবে, তাহলে শুধু তাদের সঠিকগুলোই নিলো, কিন্তু ভুল কথাগুলো কুর’আনে আসলো না – এই ব্যাপারটি কি আশ্চর্যের নয়? তাহলে মুহাম্মাদকে ﷺ এই জ্ঞান কে দিলো, যেই জ্ঞান তখন কারোরই জানা ছিলো না! সুতরাং, এতেই প্রমাণিত হয় কুরআনের ভ্রূণবিদ্যা গ্রীকদের বা অন্যান্যদের থেকে নকলকৃত নয়। বরং এই বিষয়ে আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা, মুহাম্মাদকে ﷺ জানিয়েছেন ও তাঁর মাধ্যমে আমরা জেনেছি। এ কারণে কুরআন যে আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত মুহাম্মাদের ﷺ উপর নাযিলকৃত একমাত্র সত্য গ্রন্থ এবং মুহাম্মাদ ﷺ যে সত্য নবী তাতেও কোনো সন্দেহ থাকে না।”

সামিরা মিথ্যাচারের জবাব পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকলো। পরাজয়ের ছাপ যেন তার চেহারায় ফুটে উঠেছে! তখন ফাতিমা বললো, “দেখেছিস সামিরা, তোর মুক্তচর্চা কতটুকু নড়বড়ে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিলো! মুখের ফুঁৎকারেই সব উড়ে গেলো! তুই মুক্তচিন্তা কর, তাতে আমার সমস্যা নেই। একেকজনের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে, আমি সেটাকে সম্মান করি। কিন্তু তাই বলে এই না যে, একটি ধর্মের ব্যাপারে কিছু অপপ্রচারকারীদের বক্তব্য শুনেই লাফালাফি শুরু করবি! কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে উভয়পক্ষের প্রমাণ দেখা লাগে। যদি প্রমাণ বোঝার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে যে ওই বিষয়ে অভিজ্ঞ, তার কাছে গিয়ে জানতে হবে। তারপর তুই সিদ্ধান্ত নিবি যে, কে ঠিক আর কে ভুল। ঠিকাছে?”

সামিরা চুপ করে কতক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো, “তুই কি বিশ্বাস করিস মোহাম্মদ যেসব কথা বলেছে, তার সবই যৌক্তিক?”

ফাতিমা বললো, “হ্যাঁ, তা-ই বিশ্বাস করি। সেসব কথা নাহয় আরেকদিন হবে। আজকের বিষয়ে তো পরাজয় মেনে নিলি? কী? তাই তো?”

ঘরে পিনপতন নীরবতা! আসলে সামিরা তার পরাজয় মেনে নিতে পারছে না। আজ পর্যন্ত সব বান্ধবীকেই সে এই বিষয়ে কথা বলে নাকানি-চুবানি দিয়েছে! কিন্তু ফাতিমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে এসে সামিরা তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। এই সময়ে নাবিলা বললো,

“ভাবী, আপু মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে। ঠিকাছে আপু, আপনার স্বীকার করা লাগবে না। ভাবী, তোমার কথা শুনে আমার একটি আয়াতের কথা মনে পড়লো। গতকাল আয়াতটি পড়েছি। আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মধ্যে বলেন, ‘তারা মুখের ফুঁৎকারেই আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়; অথচ আল্লাহ্‌ তাঁর নূরকে পরিপূর্ণ করে দিতে চান; যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপছন্দ করে।’[২৯] ঘটনাগুলোর সাথে আয়াতের খুব মিল, তাই না?”

ফাতিমা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। সেই চৌদ্দশ বছর আগে আরবের মরুভূমিতেও এমনই কিছু লোকের উদ্ভট সব মিথ্যাচারের পরিপেক্ষিতেই নাযিল হয়েছিলো এই আয়াত। আজও কি তাদের দৌরাত্ম্য কোনো অংশে কমেছে? না, কমেনি। বরং তা বেড়েছে। শুরু হয়েছে নতুন ধারায়। নতুন সব কৌশলে।


[কুর’আনে ভ্রূণবিদ্যা নিয়ে লেখার পরে কয়েকজন এই অভিযোগ করে যে, এই ভ্রূণবিদ্যা নাকি গ্রীকদের থেকে নকলকৃত। তাই তাদের অভিযোগ খণ্ডন করে লেখাটি লেখা। লেখাতে যা কিছু ভুল তা আমার এবং শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, তার সবটুকুই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।]

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থাবলি

[১] মিথ্যা অপবাদের লিংক: https://istishon.com/?q=node/18702

[২] বইটির ডাউনলোড লিংক: http://islamicpdfbd.com/usdul-ghabah-fi-marfat-e-sahabah-pdf-download/

[৩] উসদুল গাবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবা (আলি ইবনুল আসির রহঃ); খণ্ডঃ১; পৃষ্ঠাঃ ৪৬৯(১৯৯৩)

[৪] আল-ইসবাহ ফি তামিয়্যিজ আল-সাহাবা (ইবনে হাজার আসকালানি রহঃ); খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪-৫

[৫] The Islamic World, from Classical to Modern Times; Development of the Biography of al-Harith ibn Kalada and the Relationship between Medicine and Islam; Page 137-127

[৬] উসুদ আল-গবাহ ফি মা’রিফাত আস-সাহাবা (আলি ইবনে আল আসির রহঃ); খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৬৯ (প্রকাশকাল: ১৯৯৩)

[৭] আল-ইসবাহ ফি তামিয়্যিজ আল-সাহাবা: http://books.nafseislam.com/read-book.php?book_id=938&book=al-asaba-fe-tameez-is-sahaba—%22-muqadma-%22

[৮] Al-Isaba fi Tamyiz al-Sahaba (Makhtabat al-Hadîth ash-Sharif) by Ibn Hajar al-Asqalani (RH)

আল-ইসবাহ ফি তামিয়্যিজ আল-সাহাবা: ইবনে হাজার আসকালানি (আল- মাকতাবাতুল ইলমিয়া বাইরুত থেকে প্রকাশিত, ১ম প্রকাশ- ১৯৯৫); খণ্ড: ০১; পৃষ্ঠা: ৬৮৭

[৯] The beginning of western Science by David C. Lindberg; Chapter: 08; page: 160

E-link: https://www.academia.edu/8977007/THE_BEGINNING_OF_WESTERN_EDUCATION

[১০] The Greatest Benefit to Mankind: A Medical History Of Humanity (1997); Page no: 94

[১১] A history Of medicine By Plinio Prioreschi; Page: 364

E-link: https://books.google.com.bd/books?id=q0IIpnov0BsC&pg=PA364&lpg=PA364&dq=#v=onepage&q&f=false

[১২] Opinion Of: Ibn kathir; Al-Baghawi; Al-Qurtubi

Tafsir Ibn Kathir (Islamic Foundation, Bangladesh); Volume: 01; Page no: 29,30 (march-2014)

[১৩] ফাতহুল বারী: ইবনে হাজার আসকালানি; ৮ম খণ্ড; পৃষ্ঠা: ৪৫

[১৪] উসুদ আল-গবাহ ফি মা’রিফাত আস-সাহাবা (আলি ইবনে আল আসির রহঃ); খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৬৯ (১৯৯৩)

সীরাহ: আর-রাহীকুল মাখতুম: শফিউর রহমান মোবারকপুরী (আল-কুরআন একাডেমী পাবলিকেশন); অধ্যায়: হুনাইনের যুদ্ধ; পরিচ্ছেদ তায়েফ যুদ্ধ; পৃষ্ঠা: ৪৫২-৪৫৪

[১৫] http://sanskritdocuments.org/doc_upanishhat/garbha.html?lang=sa

ইংরেজি অনুবাদ:

1st part: The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore (10th edition); Chapter: 01; Ancient Views of Human Embryology; page: 04.

2nd part: Dr. A. G. Krishna Warrier; Published by: The Theosophical Publishing House, Chennai

E-Link:http://bharatkalyan97.blogspot.com/2014/04/a-framework-for-defining-consciousness.html

[১৬] কেউ চাইলে এখান থেকে শব্দগুলো অনুবাদ করে দেখতে পারেন: http://spokensanskrit.de/index.php?script=DI&beginning=0+&tinput

[১৭] The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore (10th edition); Chapter: 14, skeletal system development (Development of neurocranium); page: 345

[১৮] https://en.wikipedia.org/wiki/Preterm_birth#cite_note-Guinness2007-148

http://worldjournals.org/articles/James_Elgin_Gill

(Read: Notable Cases)

[১৯] http://www.cpmc.org/services/pregnancy/information/fetal_development.html

[২০] www.ece.lsu.edu/kak/GarbhaUpanishad.pdf

[২১] http://www.news-medical.net/health/Hermaphroditism-(Intersex).aspx

http://www.babymed.com/monozygotic-monoamniotic-monochorionic-mono-mono-dizygotic-dichorionic-twins

http://www.nature.com/nrg/journal/v4/n11/full/nrg1202.html?foxtrotcallback=true

[২২] Hippocrate’s Section 8, Page- 321 & Page- 326

[২৩] Textbook of medical physiology by Guyton and Hall; Chapter: Pregnancy and lactation; Topic: Human Chorionic Gonadotropin and Its Effect to Cause Persistence of the Corpus Luteum and to Prevent Menstruation and Function of Human Chorionic Gonadotropin.

[২৪] Aristotle, De Generatione Animalium, Book II, The Complete Works of Aristotle, Volume: 01, page: 1148 (Princeton, 1985; Interpreted by Prof. Dr. Keith Moore).

[২৫] Corpus Medicorum Graecorum: Galeni de Semine (Galen: On Semen); Greek text with English trans. Phillip de Lacy, Akademic Verlag, 1992; section I:9:1-10; Page: 95-92, 101

[২৬] Talmud by Great Physician Samuel ha-Yehudi (Information collected from ‘the Developing Human by Keith L. Moore; Topic: Ancient Views of Human Embryology, page- 05)

[২৭] Concepts Of Genetics by Robert J. Brooker; Chapter: 2, Patterns of inheritance

[২৮] তিন নং গল্প দ্রষ্টব্য: কুরআন কি ভ্রূণবিদ্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়?

[২৯] সূরা সাফ (৬১); আয়াত: ০৮

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive