অন্ধকার একটা রাত। যে রাতের অন্ধকার দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তেমনি এক রাতে রাস্তা দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে।

লোকটা দুর্ধর্ষ এক ডাকাত। সে এতটাই ভীতিকর যে সবার মুখে মুখে তার নিষ্ঠুরতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিলো। তার পাশ দিয়ে যাওয়াকে সবাই সাক্ষাৎ বিপদকে ডেকে আনা ভাবতো। তার আক্রমণ থেকে নিস্তার মিলতো না ধর্মপ্রাণ হজ্জযাত্রীদেরও।

IIRT Arabic Intensive

তবে লোকটার আরো একটা পরিচয় ছিলো। একটা মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো সে, হৃদয় দিয়ে চাইতো। প্রায় রাতেই সে যেতো মেয়েটার সাথে মিলিত হতে। আমাদের আজকের গল্প তেমনি অন্ধকার এক রাত নিয়ে। যে রাতে লোকটা বের হয়েছিলো মেয়েটার সাথে মিলিত হতে। মেয়ের বাড়ির দেয়াল দিয়ে উঠতে যাওয়ার সময় সে শুনতে পেলো কেউ একজন তিলওয়াত করছে:

“যারা বিশ্বাসী, তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার সময় আসেনি? তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিলো। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” [সূরা হাদীদ (৫৭):১৬]

এই আয়াতটি তার হৃদয়ে বজ্রাঘাত করলো প্রবলভাবে। তার হৃদয়কে নাড়া দিলো। নাড়িয়ে দিলো তার জীবনের তরী। বদলে দিলো বেঁচে থাকার মানেটা। কেন সে এই পৃথিবীতে এসেছে?

সে এই আয়াতটি নিয়ে ভাবতে লাগলো। তার এই বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্যই ভুলে গেলো! তার জিহ্বাতে কেবল একটিমাত্র বাক্যই উচ্চারিত হচ্ছিলো ক্রমাগতভাবে “বালা ইয়া রাব্বি আল আন” – হে আমার রব! হ্যাঁ, সেই সময় সত্যিই এসে গেছে।

হ্যাঁ! সত্যিই এসে গিয়েছিলো সে সময়। চরিত্রহীন সেই দুর্ধর্ষ ডাকাত নিজেকে স্রষ্টার কাছে সঁপে দিলেন। পরিণত হলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষে। তাঁর নাম ফুদাইল ইবন ইয়াদ (রহিমাহুল্লাহ)। যার বিভিন্ন ঘটনা ও শিক্ষা আজো লাখো মুসলিমের চলার পথের প্রেরণা। ধূসর অতীতের কিছু মানুষ মাঝে মাঝে সোনালী ভবিষ্যতের সৃষ্টি করে আল্লাহর ইচ্ছায়। ফুদাইল ইবনে ইয়াদ (রহিমাহুল্লাহ) ছিলেন তেমনই একজন।

তিনি সে বাড়ি থেকে ফিরে এলেন এবং একটা মুসাফির দলের মাঝে আশ্রয় নিলেন। দলের সবাই তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলো। তিনি শুনতে পেলেন দুইজন লোক কথা বলছে:

– “চলুন আজ রাতেই রওনা দিয়ে দিই।”
-“না, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি। আমার ধারণা ফুদাইল কোথাও না কোথাও ঘাপটি মেরে আছে আমাদের ডাকাতি করার জন্য।”

আল ফুদাইল সব শুনে ভাবলেন, “আমি প্রতি রাতেই খারাপ কাজ করি আর কিছু মুসলিম এখানে রয়ে যায়। তারা আমাকে ভয় পায়। ঘৃণা করে। মনে হয় আল্লাহ আমাকে এখানে এনেছেন যাতে আমি নিজেকে এদের দেখে শোধরাতে পারি। হে আল্লাহ! সত্যিই আমি তোমার কাছে তওবা করছি।”

পরের গল্পটুকু রূপকথার মতো। ইসলাম কীভাবে একজন মানুষকে রাতারাতি বদলে দিতে পারে সেটার গল্প। তিনি মক্কায় ফিরে এলেন এবং তাঁর লেখনী দ্বারা শত শত মানুষের জীবন পরিবর্তন করে দিলেন। ফুদাইল ইবন ইয়াদ (রহিমাহুল্লাহ) এরপর থেকে যাদের তিনি ক্ষতি করেছিলেন তাদের বাড়ি-বাড়ি যেতেন এবং তাদের ক্ষতিপূরণ করে দিতেন। যখন তার কাছে দেওয়ার কিছু থাকতো না, তখন তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।

তাঁর ভৃত্য ইবরাহিম ইবনে আল আস বলেন, “আমি ফুদাইল ইবন ইয়াদ ছাড়া আর কাউকে দেখিনি যার হৃদয়ে আল্লাহ তা’আলাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। যখন তাঁর সামনে আল্লাহ তা’আলার কথা উল্লেখ করা হতো কিংবা যখনই তিনি কুরআন শুনতেন, প্রচণ্ড দুঃখ ও ভয় তাঁকে পেয়ে বসতো। তাঁর চোখ পানিতে ভরে যেতো আর তিনি এতটাই কাঁদতেন যে, যারা তাঁর নিকটে বসে থাকতেন তাঁরাও তাঁকে দেখে কষ্ট পেতেন।”

একবার ইমাম আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক (রহিমাহুল্লাহ) তাঁকে একটা কবিতা চিঠি লিখে পাঠালেন যাতে লিখা ছিলো

হে দুই হারামের অধিবাসী,
তুমি যদি আমাদের দেখতে তাহলে বুঝতে তুমি কেবল পরিহাসের ইবাদত করছ।
কেঁদে কেঁদে (ইবাদত করে) যে তার গাল ভিজিয়ে ফেলে,তার জানা উচিৎ
আমাদের ঘাড় রক্ত দিয়ে ভিজে যাচ্ছে।”

চিঠি পড়ে ফুদাইল ইবনে ইয়াদ (রহিমাহুল্লাহ) কী করলেন? তিনি কি আল্লাহর ইবাদতকে পরিহাস করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহিমাহুল্লাহ)-কে উপহাস করেছিলেন? আমাদের সময়ে হলে হয়তো তা-ই হতো।

কিন্তু গল্পটা তো আল্লাহর স্মরণে হৃদয় বিগলিত হয়েছে এমন এক মানুষের। তাই চিঠি পড়ে তাঁর হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেলো। চোখ পানিতে ভরে গেলো। তিনি প্রচুর কাঁদলেন এবং বললেন, “আবু আব্দুর রহমান (আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক) আমাকে একটি আন্তরিক উপদেশ দিয়েছেন।” অথচ একই কবিতা হাজার বার পড়লেও আমাদের হৃদয়ে কোনো আঁচড় পড়ে না।

তাঁর করা কিছু অসাধারণ উক্তি:

“যদি কেউ একাকীত্বে কষ্ট পায় আর লোকজন পাশে থাকলে শান্তি পায়, তবে সে রিয়া থেকে নিরাপদ নয়।”

“যদি কেউ আল্লাহকে ভয় করে, তবে কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে, তবে তাকে কেউই সাহায্য করতে পারবে না।”

“যদি কেউ তোমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি আল্লাহকে ভালবাসো?’ তবে চুপ থেকো। কারণ যদি তুমি না বলো, তাহলে তুমি একজন অবিশ্বাসী। কিন্ত তুমি যদি হ্যাঁ বলো, তাহলে তো তোমার কাজের সাথে তোমার কথা মিলে না।”

“যতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলে, মানুষের আসল চরিত্র গোপন থাকে। কিন্ত যখন কোনো বিপদ আপতিত হয়, তখন তাদের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। কারণ তখন মুমিনরা তাদের বিশ্বাসের দিকে ফিরে যায় আর মুনাফিকরা তাদের ভণ্ডামির নিকট ফিরে যায়।”

আবু আল রাজি বলেন, “আমি ফুদাইল ইবন ইয়াদের কাছে ত্রিশ বছর ছিলাম। যেদিন তাঁর ছেলে আলী মারা গিয়েছিলো, সেদিন ছাড়া আমি তাঁকে কখনোই হাসতে দেখিনি। আমি (অবাক হয়ে) তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘যদি আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট থাকেন, তবে আমি কীভাবে এতে অসন্তুষ্ট থাকি?’”

সত্যিই যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তা’আলাই শ্রেষ্ঠ, তারা কীভাবে তাঁর ফয়সালায় অসন্তুষ্ট হতে পারে? তাদের জীবন-মরণ তো কেবল আল্লাহর জন্যই। তাদের সকল দুঃখ-কষ্ট তো কেবল তারা আল্লাহর নিকটেই জানায়। কারণ, তাদের হৃদয় বহু পূর্বেই আল্লাহর স্মরণে বিগলিত হয়েছে।

ফুদাইল ইবনে ইয়াদ (রহিমাহুল্লাহ)-এর হৃদয় বিগলিত হয়েছিলো অন্তরটা পুরোপুরি মরে যাবার আগেই।

আমাদের হৃদয় বিগলিত হবার সময় কি আসেনি?

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive