আগের আর্টিকেলে আমরা সুখ লাভের মাধ্যমগুলো আলোচনা করেছি যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈমান। এবার আমরা কাঙ্ক্ষিত সুখ লাভের পথে কিছু বাধার দিকে মনোযোগ দেবো।

এক এর প্রথমটি হলো হিংসা। যার অন্তর অন্যের প্রতি হিংসায় পূর্ণ, তার পক্ষে সুখী হওয়া অসম্ভব। অন্যের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হতে দেখে যে কষ্ট পায়, সে কী করে সুখী হওয়ার আশা করতে পারে? আল্লাহ বলেন,

IIRT Arabic Intensive

“যা কিছু আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে দান করেছেন, সে বিষয়ের জন্য কি মানুষকে তারা হিংসা করে?” (সূরা নিসা ৪:৫৪)

এক কবি লিখেছিলেন,

“আমার হিংসুকদের প্রতি আমার করুণা,

কী করে হিংসার আগুন তাদের বক্ষে ফুলে ফেঁপে উঠছে!

আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তা তারা মেনে নিতে পারে না

দৃষ্টি স্বর্গে থাকলেও হৃদয় তাদের নরকেই ঢুকছে।”

দুইদ্বিতীয় বাধা হলো লোভ। যার অন্তর লোভে পরিপূর্ণ, তার পদতলে পৃথিবী এনে দিলেও সে সন্তুষ্ট হবে না।

তিনতৃতীয় বাধা হলো একঘেয়েমি। সবচেয়ে আনন্দদায়ক কাজটাও বারবার করতে করতে একসময় ক্লান্তি চলে আসে।

আন্দালুসিয়ান বাদশাহ আল-মু’তামাদ ইবনু ‘উব্বাদ এবং তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের কথা মনে পড়ে গেলো। তাঁরা এক আলিশান ও আরামদায়ক প্রাসাদে বাস করতেন। কিন্তু তারপরও বাদশাহর ঘরের মহিলারা তাতে একঘেয়ে হয়ে পড়েন। তাঁরা বললেন, “আমরা মরুবাসীদের জীবন কেমন তা দেখতে চাই।” প্রত্যেক নারীই একটি করে চামড়ার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কাদা মাড়িয়ে হাঁটা দিলেন, যাতে তাঁদের জীবনেও মরুবাসীদের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। কারাবাসের সময় আল’মু’তামাদ তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।

এ কারণেই আল্লাহ বৈচিত্র্যকে মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ বানিয়েছেন। একঘেয়েমি দূর করার জন্য কাজগুলোকে বৈচিত্র্যময় করলেই হয়ে যায়। খাদ্য-পানীয়ে বদল আনা যায়। পঠিতব্য বইয়ের তালিকায় পরিবর্তন আনা যায়। স্বামী বা স্ত্রীর সাথে আনন্দ করার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া যায়। অধিক বিষয়ে আগ্রহ থাকলে সহজেই একঘেয়েমি এড়ানো যায়।

লেবুর কথাই ধরুন। কেউ যদি দিনের পর দিন একইভাবে লেবু খেতে থাকে, সে বিরক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু যদি একদিন সে লেবুর শরবত বানিয়ে পান করে, আরেকদিন রান্নার সাথে লেবু দেয়, আরেকদিন তা দিয়ে মিছরি বানায়, তাহলে সে অনেকদিন আনন্দ ধরে রাখতে পারবে।

এই গেলো একরকম পদ্ধতি। আরেকটি হলো সাময়িকভাবে নিজেকে বঞ্চিত করা। আল্লাহ অনেক আনন্দ থেকেই আমাদের বিরত থাকার হুকুম দিয়েছেন যাতে আমরা এর আনন্দ বেশি করে অনুভব করতে পারি। যেমন সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকার পর ইফতারি আমাদের কাছে অনেক তৃপ্তিদায়ক ঠেকে। প্রিয় মানুষের সাথে দীর্ঘদিন পর দেখা করাটাও তার সাথে প্রতিদিন সাক্ষাৎ করার চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক।

এমনকি নিজেদের দৈনন্দিন জীবনেও আমরা বৈচিত্র্যের প্রভাব উপলব্ধি করতে পারি। কয়েকদিন হাসপাতালের বিছানায় বা কারাগারে কাটানোর পর মুক্তির স্বাদ কতই না ভালো লাগে! অথবা লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুৎ ফিরে এলে?

আল্লাহ যখন আমাদের কোনো কিছু উপভোগ করা থেকে বিরত থাকতে বলেন, তখন বুঝতে হবে যে এর পেছনে কোনো না কোনো হিকমাহ আছে। নিজেদের লাভের জন্যই মাঝেমাঝে নিজেকে বঞ্চিত করা উচিৎ। কখনো কখনো তা ধর্মীয় বিধানরূপেও আসে। যেমন- প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ সওম পালন করা।

চারসুখের পথে চতুর্থ বাধা হলো গুনাহের চিন্তা। যেসব গুনাহ হয়ে আছে আর যেসব গুনাহ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেগুলো স্বভাবতই একজন মুসলিমের মনের শান্তি হরণ করে। একটু ঘুমাতে গেলেও পাপের স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। হারাম দৃষ্টিপাত, গীবত শেকায়েত, ঘন্টাব্যাপী কৃত গুনাহ, সবকিছু মাথায় ঘুরে বেড়ায়।

এই বিষয়টা মোকাবেলা করা আমাদের শিখতে হবে। আমাদের ঘনঘন তাওবাহ ইস্তিগফার করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে আমাদের আমলের দ্বারা আমরা কেউই নাজাত পাবো না, পাবো আল্লাহর রহমতের দ্বারা। নেককারদের বর্ণনায় আল্লাহ বলেন,

“তারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (সূরা আলে ইমরান ৩১:৩৫)

আল্লাহ আরও বলেন,

“হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছো, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সূরা সূরাহ আয-যুমার ৩৯:৫৩)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তোমাদের এমন জাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে দিতেন যারা গুনাহ করতো অতঃপর অনুতপ্ত হয়ে তাওবাহ করতো, ফলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতেন।” (সাহীহ মুসলিম)

পাঁচপঞ্চম বাধা হলো নিজেকে নিজের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত মনে করা। অনেকে এমন আছে যাদের কাছে সুখী হওয়ার সকল উপকরণ আছে। কিন্তু সমাজ বা আশেপাশের মানুষেরা তার প্রতি জুলুম করেছে ভেবে সে সুখী হতে পারে না।

এই সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো এই কথা মনে রাখা যে, আমরা বিশুদ্ধ নিয়্যাতে যা-ই করি না কেন, একসময় না একসময় এর পূর্ণ প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যাবে।

দ্বিতীয় ধাপ হলো অতিরিক্ত লক্ষ্যের বোঝা নিজের উপর না চাপানো। আমাদের নিজের দরকারী কাজগুলোকেও আমরা অনেকসময় বৈশ্বিক গুরুত্বের বিষয় বলে ধরে নেই। আমাদের করা মহান কাজগুলোও নিজস্ব লাভের ধ্যানধারণা দিয়ে দূষিত হয়। যেসব কাজ আমরা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে করছি বলে ভাবি, সেগুলোতেও আমাদের অজান্তেই নিজের লাভ আশা করি। তাই আমাদের উচিৎ নিজেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ না ভাবা এবং আশার পারদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

তৃতীয় ধাপ হলো, আমরা অন্যের সাথে যেমন আচরণ করি, তাদের কাছে ঠিক অনুরূপ পাওয়ার আশা না করা। আমরাও তো অন্যের দরকারের চেয়ে নিজের দরকারকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি, তাই নয় কি?

চতুর্থ ধাপ হলো, সবসময় আমার বিরুদ্ধে কোথাও না কোথাও ষড়যন্ত্র চলছে এমন ধারণা ত্যাগ করা।

এই গেলো সুখ লাভের পথে কিছু বাধা। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর আনুগত্য আর কোরআন সুন্নাহর অনুসরণের মাঝেই সত্যিকারের সুখ-শান্তি। আল্লাহ বলেন,

“যারা আমার পথে সাধনায় (জা-হাদু) আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করবো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।” (সূরা আল-আনকাবুত ২৯:৬৯)


উৎস: 5 Obstacles to Happiness (মূল আর্টিকেল লিংক

অনুবাদক: আরমান নিলয়, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি

অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive