পর্ব ০১ | পর্ব ০২ | পর্ব ০৩ | পর্ব ০৪

আর-রহমান এবং আর-রহিম আল্লাহর নামে

IIRT Arabic Intensive

সূরা কাহফে আল্লাহ তা’আলা অতীতের চারটি উল্লেখযোগ্য সত্য ঘটনা উল্লেখ করেছেন আমাদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য। এর মাঝে প্রথম ঘটনাটি অর্থাৎ গুহাবাসী যুবকদের ঘটনাটিতে আমাদের জন্য কী শিক্ষা আছে তা নিয়ে গত পর্বে লিখা হয়েছিলো। এই পর্বে ইনশাআল্লাহ দ্বিতীয় ঘটনা অর্থাৎ দুই বন্ধুর ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং এর মাঝে নিহিত শিক্ষাগুলি জানার চেষ্টা করা হবে। এই ঘটনাটি সূরা কাহফের ৩২-৪৪ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। এই ঘটনার মূলকথা হলো- “সম্পদের পরীক্ষা”। এছাড়াও এতে এসব শিক্ষা রয়েছে-  

(১) অতিরিক্ত পার্থিব সম্পদের ভয়াবহতাঃ

মানুষের জীবনধারণের জন্য সম্পদের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু অতিরিক্ত সম্পদ অনেক সময় আল্লাহর দ্বীন ও স্মরণ থেকে আমাদেরকে গাফেল করে ফেলতে পারে। সম্পদের লোভে অন্ধ মানুষের হাতে যখন সম্পদ এসে যায় তখন এই সম্পদ তাকে ইহকাল তো বটেই, পরকাল সম্পর্কেও গাফেল করে দিতে পারে। এই বিষয়টি আমরা জানতে পারি মহান আল্লাহর এই বাণী থেকে-

“আপনি তাদের কাছে দু ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে দুটি আঙ্গুরের বাগান দিয়েছি এবং এ দু’টিকে খর্জুর বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি এবং দু এর মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র। উভয় বাগানই ফলদান করে এবং তা থেকে কিছুই হ্রাস করতো না এবং উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমি নহর প্রবাহিত করেছি। সে ফল পেলো। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বললো, আমার ধন-সম্পদ তোমার চাইতে বেশী এবং জনবলে আমি অধিক শক্তিশালী। নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করলো। সে বললো, আমার মনে হয় না যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং আমি মনে করি না যে, কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। যদি কখনও আমার পালনকর্তার কাছে আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়, তবে সেখানে এর চাইতে উৎকৃষ্ট পাবো।”

[সূরা কাহফ(১৮): ৩৩-৩৬]

এখানে দেখা যায়, আল্লাহ সেই দুই বন্ধুর একজনকে এমন দুটি বাগান দিয়েছিলেন যেগুলো ছিল খেজুর গাছ দিয়ে পরিবেষ্টিত, সর্বদা ফলদানকারী, দুয়ের মাঝে ছিল শস্যক্ষেত্র আর জলাশয়। অর্থাৎ সবদিক দিয়েই এই বাগান দুটি ছিল একজন কৃষকের জন্য স্বপ্নতুল্য। এই বিরাট নিয়ামত পেয়ে অহংকারী বন্ধুটি নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করলয়। প্রথমে সে দাবী করল এই দুনিয়াবী সম্পদ অবিনশ্বর, এরপর সরাসরি পরকালকেই অস্বীকার করে বসলো। আল্লাহ আমাদেরকে এমন সম্পদ থেকে রক্ষা করুন যা আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয়।

(২) পাপী ব্যক্তি মূলত নিজের উপরেই জুলুম করেঃ

আল্লাহ বলেন- “…নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করলো।… ” [সূরা কাহফ(১৮): ৩৫]

মানুষের পাপের ভার মানুষকেই বহন করতে হয়, হয় ইহকালে নয়তো পরকালে। পাপের কারণে একজন মানুষ অন্যের যে ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে নিজের। একারণে পাপ মূলত নিজের উপরেই জুলুম।

(৩) ‘পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী’-একথা মনে রেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাঃ

দুনিয়াবী ধন-সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। স্থায়ী কেবল বান্দার আমল। আল্লাহ চাইলে নিমেষের মধ্যেই আমাদের সমস্ত ধন-সম্পদ কেড়ে নিতে পারেন। আলোচ্য ঘটনায় অহংকারী বন্ধুটি অহংকার করার কারণে আল্লাহ শাস্তিস্বরূপ তার স্বপ্নের বাগান ধংস করে দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন-

“অতঃপর তার সব ফল ধ্বংস হয়ে গেলো এবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিলো, তার জন্য সকালে হাত কচলিয়ে আক্ষেপ করতে লাগলো। বাগনটি কাঠসহ পুড়ে গিয়েছিলো…” [সূরা কাহফ(১৮): ৪২]

সুতরাং এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব সম্পদে আকৃষ্ট হওয়া কোনো মুমিনের কাজ নয়। হালাল পন্থায় জীবন নির্বাহের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুর দিকেই আমাদের দৃষ্টিপাত করা উচিৎ। পাশাপাশি আমাদেরকে দেওয়া আল্লাহর সমস্ত সম্পদের জন্য সার্বক্ষণিক আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে, মনে রাখতে হবে এই সম্পদ প্রাপ্তির পেছনে আমাদের কোনো হাত নেই। একমাত্র আল্লাহই মানুষকে সম্পদ দেন, আবার আল্লাহই সম্পদ কেড়ে নেন। সম্পদের মোহে অন্ধ হয়ে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া তাই চূড়ান্ত মূর্খতা। দ্বীনদার বন্ধুটি তার অহংকারী বন্ধুকে সম্পদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলো-

“যদি তুমি আমাকে ধনে ও সন্তানে তোমার চাইতে কম দেখো, তবে যখন তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করলে, তখন এ কথা কেন বললে না; আল্লাহ যা চান, তা-ই হয়। আল্লাহর দেওয়া ব্যতীত কোন শক্তি নেই।” [সূরা কাহফ(১৮): ৩৯]

(৪) দাওয়াহর পদ্ধতিঃ

অহংকারী বন্ধুটি তার পার্থিব সম্পদকে অবিনশ্বর ভেবে শেষ পর্যন্ত পরকালকে অস্বীকার করার মাধ্যমে কুফরি করেছিলো। পরিণামে তার দ্বীনি বন্ধুটি তাকে প্রথমেই আল্লাহর অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। সে চাইলে প্রথমে বোঝাতে পারতো কেন এই পার্থিব সম্পদ ধ্বংসশীল। কিন্তু তা না করে সে শুরুতেই আল্লাহর অস্তিত্বের কথা এবং মানুষ কত তুচ্ছ অবস্থা থেকে ধাপে ধাপে পরিপূর্ণ বয়সে উপনীত হয় (অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্যের কথা) স্মরণ করিয়ে দিলো। মহান আল্লাহ বলেন-

“তার সঙ্গী তাকে কথা প্রসঙ্গে বললো, তুমি তাঁকে অস্বীকার করছো, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর বীর্য থেকে, অতঃপর র্পূনাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানবাকৃতিতে?” [সূরা কাহফ(১৮): ৩৭]

 যদিও অহংকারী বন্ধুটি সরাসরি আল্লাহকে অস্বীকার করার কথা বলেনি বরং বিচার দিবসকে অস্বীকার করেছিলো, তথাপি দ্বীনি বন্ধুটির উপরোক্ত কথা থেকে বোঝা যায় বিচার দিবসকে অস্বীকার করা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শামিল।

আল্লাহর অস্তিত্বের দাওয়াহ দেওয়ার পর সে আল্লাহর তাওহীদের দাওয়াহ দিলো। মহান আল্লাহ বলেন-

 “কিন্তু আমি তো একথাই বলি, আল্লাহই আমার পালনকর্তা এবং আমি কাউকে আমার পালনকর্তার শরীক মানি না।” [সূরা কাহফ(১৮): ৩৮]

 এভাবেই দ্বীনদার বন্ধুটি আল্লাহর তাওহীদের দাওয়াহ দেওয়ার পাশাপাশি শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করেছিলো। এছাড়াও আল্লাহর আযাবের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করতে হবে। এটাও দাওয়াহর অন্তর্ভুক্ত। দ্বীনদার বন্ধুটি তার বন্ধুকে সতর্ক করে বলেছিলো-

“…তার (তোমার বাগানের) উপর আসমান থেকে আগুন প্রেরণ করবেন। অতঃপর সকাল বেলায় তা পরিষ্কার ময়দান হয়ে যাবে। অথবা সকালে তার পানি শুকিয়ে যাবে। অতঃপর তুমি তা তালাশ করে আনতে পারবে না…” [সূরা কাহফ(১৮): ৪০-৪১]

(৫) আল্লাহ-র কাছে উত্তম প্রতিদানের আশা রাখাঃ

প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হলো ঈমান ও সৎ আমল বজায় রাখার পাশাপাশি কিয়ামাতের দিন আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান আশা করা। আলোচ্য ঘটনার দ্বীনদার বন্ধুটি এর ব্যতিক্রম ছিলো না। সে বলেছিলো-

“আশাকরি আমার পালকর্তা আমাকে তোমার বাগান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কিছু দেবেন…”

[সূরা কাহফ(১৮): ৪০] 

(৬)পাপ করে ফেলার পর আল্লাহর দিকে ফিরে আসাঃ

মানুষের দ্বারা পাপ হতেই পারে। কিন্তু আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বোত্তম যে পাপ করে ফেলার পর দ্রুত অনুতপ্ত হয়, তাওবাহ করে এবং ভবিষ্যতে পাপ না করার দৃঢ় সংকল্প করে। তাওবাহর ফযীলত কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং অসংখ্য হাদীস থেকে প্রমাণিত। এই শিক্ষাটি আমরা দেখি সেই অহংকারী বন্ধুটির মাঝে যখন তার বাগান আল্লাহর আযাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো আর সে বলেছিলো-

“অতঃপর তার সব ফল ধ্বংস হয়ে গেলোএবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিলো, তার জন্য সকালে হাত কচলিয়ে আক্ষেপ করতে লাগলো। বাগনটি কাঠসহ পুড়ে গিয়েছিলো। সে বলতে লাগলো, হায়! আমি যদি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক না করতাম…” [সূরা কাহফ(১৮): ৪২]

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive