আমার পুরো লেখাটার ফাইন্ডিংস আসলে এইপহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে যেই আচার-পার্বণগুলোকে হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতির অংশ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা একেবারেই প্রতারনামূলক এবং শঠতাপুর্ণ। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা সনের সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই। ঘটা করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সংস্কৃতির বয়স পঞ্চাশ বছরেরও কম। এই ব্যাপারগুলো বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলে ধৈর্য নিয়ে পুরো লেখাটা পড়বেন

সেই বেলার কথা:

কৃষিকাজের সাথে ঋতুর সম্পর্ক একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঋতু এবং কৃষিকাজের মধ্যে আপাতঃ দৃষ্টিতে একটা Causal Relationship[] আছে। তবে হিজরি সনের সাথে ঋতুর কোন Causal Relationship তো একেবারেই নেই, Correlation[] টাও একবারে শূন্যের কাছে।

IIRT Arabic Intensive

এর কারন কী? কারনটা হল, সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনের আর চন্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিনের। প্রতি বছরই হিজরি সন আগাতে থাকে। ফলে কোন বছরে গ্রীষ্মকালের শুরু হিজরি সনের যে তারিখে হবে, পরের বছরে গ্রীষ্মের শুরু হিজরি সনের ঠিক একই তারিখে পড়বেনা। কোন ঋতুর স্টার্টিং পয়েন্ট আর এন্ডিং পয়েন্ট জানার জন্য হিজরি তারিখের ওপর নির্ভর করলে ফলাফল কিছুটা মিসলিডিং হবে।

রাজ্যের সব কাজ হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে করা হলেও কৃষিকাজের জন্য যে হিজরি সনকে অনুকরণ করে চলা কিছুটা কঠিন, এই ব্যাপারটা মোগল সম্রাট আকবর বেশ ভাল করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর তাই কৃষিকাজ এবং খাজনা আদায়ে সুবিধার্থে তিনি আলাদা একটা পঞ্জিকা প্রবর্তনের আদেশ করেন।

আদিষ্ট হয়ে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম প্রচলন করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সন থেকে। এর মানেটা হল, পঞ্জিকা পরবর্তীতে আসলেও সন এবং তারিখ গণনা করা হয় আরও অনেক আগে থেকে। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ, Bengali Wikipedia: পহেলা বৈশাখ)[৩]

নতুন এই প্রবর্তিত সনের প্রথম নাম ছিল ‘ফসলি সন’। এখন আমরা একে ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা বর্ষ’ নামে জানি।

কী হত এই সন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে? আজ পহেলা বৈশাখে যা হতে দেখি তাই কি হত না অন্য কিছু হত? চলুন দেখে নেই:

Bengali Wikipedia-তে লেখা আছে,

এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।” (Bengali Wikipedia: পহেলা বৈশাখ)[৪]

আকবারের সময় থেকেই বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির সেই মালিকেরা তাদের কৃষকদের মিষ্টিমুখ করাতেন। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ, Bengali Wikipedia: পহেলা বৈশাখ)[৫]

Banglapedia-তে আরও বলা,

রাজস্ব বন্দোবস্ত ও আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে পুণ্যাহ ছিল একটি মুগল যুগের ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সকল জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার এবং অন্যান্য রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিদেরকে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হতো। এ অনুষ্ঠানে পূর্বের বছরের রাজস্ব পরিশোধ করা হতো এবং নতুনভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। এ উপলক্ষ্যে নওয়াব দরবার পরিচালনা করতেন এবং যেসকল ব্যক্তি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারতেন তাদেরকে তিনি সম্মানসূচক খিলাত বা পোশাক পরিয়ে দিতেন। এভাবে জমিদার ও অন্যান্য ভূস্বামীও তাদের রায়ত বা প্রজাবর্গকে নিয়ে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান পালন করতেন। রায়তগণ বিগত বছরের বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতেন এবং নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। রায়তগণ জমিদারের কাচারিতে একত্রিত হতেন এবং জমিদার অথবা তার নায়েবের কাছ থেকে পান-সুপারি গ্রহণ করতেন। এ উপলক্ষে গবাদি পশুর দৌড়, মোরগ লড়াই সহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। মুগল আমলে পুণ্যাহর নির্দিষ্ট কোন তারিখ ছিল না। যখন থেকে এ উৎসব রাজস্ব বন্দোবস্ত এবং রাজস্ব সংগ্রহের সাথে যুক্ত হলো, তখন থেকেই পুণ্যাহর তারিখ প্রধান ফসল তোলার সময়ে সাধারণভাবে নির্ধারিত হতো। এ বিষয়ে মুর্শিদকুলী খান এর নতুন রীতি হলো, চৈত্র মাসে (বাংলা সনের শেষ মাস, এর ইংরেজি সালের অনুরূপ মাস হলো মার্চ-এপ্রিল) ফসল তোলা শেষ হওয়ার পর পুণ্যাহ উৎসব পালন করা। এরপর তিনি রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণ করতেন।(Banglapedia: পুণ্যাহ)[৬]

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। হালখাতা মানে হিসাব রক্ষণের পুরাতন বই হালনাগাদ করে নতুন বই খোলা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ, Bengali Wikipedia: পহেলা বৈশাখ)[৭]

এই বেলার কথা:

পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে পুরনাঙ্গ ধারনা পেতে চাইলে প্রথমেই যেই ব্যাপারটা আপনাকে একদম ভুলে যেতে হবে সেটা হল – পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি। এখন চলছে ১৪২২ বঙ্গাব্দ। ১৪২২ সংখ্যাটা দেখে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না কারন আগেই এই ব্যাপারটা বলা হয়েছে যে বাংলা সন প্রবর্তিত হয় হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে। মাঝখানের এই ১৪২২ সংখ্যাটা হিজরি পঞ্জিকার দান ছাড়া কিছুই নয়।

বাংলা সন প্রচলন হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, আজকে থেকে ৪৩২ বছর আগে। যদি আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকেই হিসাব করা হয় তাহলেও সেটা মাত্র (১৫৫৬-২০১৬) ৪৬০ বছরের পুরনো হয়। একেবারে সহজ করে বলতে গেলে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি তো ঠিক, তবে সেটা ৬০০ বছর কম হাজার বছরের সংস্কৃতি।

এবার চলুন এই ৬০০ বছর টাকেও আরও বাড়িয়ে দেয়া যাক।

Bengali Wikipedia-তে লেখা,

আধুনিক পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে ওই বছর পহেলা বৈশাখে ‘হোম কীর্তন’ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।” (প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ, মুহাম্মদ লুৎফুর হক দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮)[৮]

১৯১৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত বছর ৯৯; হাজার নয়।

এখন কিছু ‘হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি’র সাথেও পরিচিত হই।

ছায়ানট আর রমনাবটমূল দিয়েই শুরু করি:

Bengali Wikipedia-তে লেখা আছে,

“বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনা বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়।” (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ, Bengali Wikipedia: পহেলা বৈশাখ)[৯]

পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানটাই হল ছায়ানটের শিল্পীদের গান দিয়ে বর্ষকে বরণ করে নেয়া। তবে গানের মাধ্যমে বৈশাখ বরনের এই চল ছায়ানট কবে থেকে শুরু করল সেই ব্যাপারে দুটো মত পাওয়া যায়ঃ

Banglapedia-এর মতে, ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে

আর Bengali Wikipedia-এর মতে, ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। (রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে, নওয়াজেশ আহমদ, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮)[১০]

এই দুটো মতের মধ্যে দ্বিতীয় মতটা অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল থেকে বর্ষ বরন শুরু করার মতটা অধিক গ্রহণযোগ্য। কারন Bengali Wikipedia অনেকগুলো সোর্স থেকে তথ্য নিয়ে মূল আর্টিকেলটা সাজিয়েছে।

১৯৬৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত বছর ৪৯; হাজার নয়।

তবে সালটা ১৯৬৫ই হোক বা ১৯৬৭, কোনভাবেই ১৯৬১-এর আগে হতে পারেনা। কারন ছায়ানট প্রতিষ্ঠাই হয় ১৯৬১ সালে।

“…ছায়ানট একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংস্কৃতিচর্চায় দেশিয় ঐতিহ্য ও প্রকৃতিমুখী হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৬১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন করার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানি শাসনের প্রতিকূল পরিবেশে কিছু বাঙালি একত্র হয়েছিলেন নিজেদের সংস্কৃতির প্রধান ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষপূর্তির উৎসব করার জন্যে। তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানি যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। বিশ্বে শতবার্ষিকীর আয়োজন বাংলার এ প্রান্তের সংস্কৃতি-সচেতন মানুষের মনেও চাঞ্চল্য জাগায়। বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, গোবিন্দচন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বুদ্ধিজীবী যেমন উদ্যোগী হলেন-তেমনি ঢাকার কিছু সংস্কৃতিকর্মীও এগিয়ে আসেন শতবর্ষ উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে। সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর সফল উদ্যোগ। পরে সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), সায়েরা আহমদ, শামসুন্নাহার রহমান (রোজ বু), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকের ‘ভীমরুল’), ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, সন্জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিকসহ বহু অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার লক্ষ্যে একটি সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। ছায়ানট সে উদ্যোগের ফল।” (Banglapedia: ছায়ানট)[১১]

অর্থাৎ রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের তীব্র অভিপ্রায়ে কিছু রবীন্দ্র ভক্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠত হয় ছায়ানট। ছায়ানটের জন্মই যেখানে ৫৪ বছর আগে, সেখানে গানের মাধ্যমে রমনাবটমূলে বর্ষবরণ করাকে হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া প্রথম শ্রেণির একটা কৌতুক।

এবার কথা বলি মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে:

Bengali Wikipedia-তে লেখা আছে,

“ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে শোভাযাত্রার জন্য বানানো নয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।” (রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে, নওয়াজেশ আহমদ, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮)[১২]

অর্থাৎ শেয়াল-কুকুর আর ভুত-পেত্নীর মুখোশ পরে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বর্ষ বরনের যেই চলটা শুরু হয়েছে তা খুব বেশিদিন আগের নয়; মাত্র ২৬ বছর আগের।

পহেলা বৈশাখের নারীদের পরিহিত সাদা শাড়ি, চুড়ি-ফুল আর আর পুরুষদের ধুতি-পাঞ্জাবির সংস্কৃতি নিয়ে বলতে গেলে এক বাক্যে যেটা বলে দেয়া উচিত সেটা হল, এই সবই হাল আমলের সংস্কৃতি; হাজার বছরের বাঙ্গালিপনার কিছুই নেই এতে।

Banglapedia-তে স্পষ্ট করেই বলা আছে, “বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উৎযাপিত হয়।”[১৩]

সেটা কেমন? ঠিক পরের বাক্যেই ব্যাপারটা খোলাসা করে দেয়া হয়েছে,

“পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়িহাতে চুড়িখোপায় ফুলগলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরেআর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে।”

আর পহেলা বৈশাখে নগরজীবনের পান্তা ভাতের ব্যাপারটাও Banglapedia-এর লেখক এবং সংকলকরা গ্রামীণসমাজের সংস্কৃতির সাথে এক করে দেখতে রাজী নয়। তাদের মতে, “এদিন সকালবেলা পানতা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে”। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ)[১৪]

অতীতে গ্রামীণ সমাজে প্রতিটা বাড়িতে বাড়িতে বৈশাখের প্রথম দিনে ভাল ভাল খাবার আয়োজন করার চেষ্টা করা হত। পান্ত তো বছরের অন্য সব দিনেই খাওয়া হত। আজও গ্রামে গেলে বৈশাখের প্রথমদিনে ভাল ভাল খাবার খাওয়ার এই রেওয়াজটা দেখতে পাবেন।

তাহলে আয়োজন করে এভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ব্যাপারটা শুরু হল কীভাবে?

Banglapedia-তে লেখা আছে,

“সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তৎকালীন আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদস্বরূপই বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। পরে ক্রমশই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধে ও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা নববর্ষ পালিত হতে থাকে।” (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ)[১৫]

অর্থাৎ, পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপারটাকে টেনে-টুনে বড়জোর ৬০’এর দশকে নেয়া যায়। তবে এর সঙ্গে আকবরের প্রবর্তিত বাংলা সনের সম্পর্ক যতটাই একবারে নেই ঠিক ততটাই আছে রবীন্দ্রনাথের সাথে, রবীন্দ্রবন্দনার সাথে।

এবার শহুরে সমাজকে বাদ দিয়ে গ্রামীণসমাজের দিকে তাকাই। কৃষিকাজের সাথে ঋতুর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আবার কৃষিকাজের সাথে গ্রামীণসমাজের সম্পর্কও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একদম সহজ করে তাই বলতে গেলে, গ্রামীণসমাজের সাথেই বরং পহেলা বৈশাখের খুব শক্ত একটা সম্পর্ক থাকা উচিত।

আর তাই গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে গোসল করে পূত-পবিত্র হয়। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ)[১৬]

এ দিনে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ)[১৭]

গ্রামে এই দিনে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরি করা হয়। (Banglapedia: পহেলা বৈশাখ)[১৮]

দুইবেলার কথাগুলো যদি এবার সারমর্ম করি তাহলে দেখতে পাব,

সেই বেলায় যা হত:

▪ পহেলা বৈশাখের আগেরদিন কৃষক কর্তৃক জমির খাজনা পরিশোধ

▪ পহেলা বৈশাখের দিন ভূমি মালিক কর্তৃক সেই কৃষকদের মিষ্টিমুখ

▪ পুণ্যাহ

▪ হালখাতা

আর এগুলো সবই সাড়ে চারশোর বছরের আগের কাহিনী। উৎসব ছিল মুলত কৃষকসমাজে। শুধু এই দিনটাকে পালন করার উদ্দেশ্যেই আলাদা করে কোন আয়োজন করা হতনা বরং মানুষের কর্মের কারনেই দিনটা বিশেষ তাৎপর্য পেয়েছিল।

এই বেলায় যা হয়:

▪ বটমূলে ছায়ানটের রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে বর্ষ বরণ

▪ জন্তু-জানোয়ারের ছবি সম্বলিত মুখোশ পড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা

▪ সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা, কপালে টিপ আর পাজামা-ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রাস্তা-ঘাটে ঘোরাঘুরি করা

▪ পান্তা ভাত খাওয়া

▪ Origin-এর সাথে সম্পর্কহীন রবীন্দ্রবন্দনায় নববর্ষ পালন

এগুলোর বয়স পঞ্চাশ বছরেরও কম। উৎসব মুলত শহর কেন্দ্রিক, আয়োজন করে এই দিনকে পালন করা হয়।

আমার মূল ভাষ্য হল, হাল আমলের ঘটা করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সংস্কৃতির সাথে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা সনের কোন সম্পর্ক নেই। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা সন প্রবর্তিত হওয়ার পর কৃষকরা হাফ ছেড়ে বাঁচেন। এখন থেকে আর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তাদের খাজনা পরিশোধ করতে হবেনা। আনন্দে খাজনা পরিশোধ করে বৈশাখের প্রথম দিনে কৃষকসমাজ উপরে সেই বালার কথায় বর্নিত কাজগুলো করত, যেগুলোর সাথে এবালার কথায় বর্ণিত কোন কাজেরই মিল নেই। যেই নিয়তে যেই অভিপ্রায়ে পহেলা বৈশাখ সেটার সাথে নিকটতম সম্পর্ক আছে গ্রামীণসমাজের স্বাভাবিক কিছু কাজগুলোর সাথেই।

তাহলে মানুষ কেন নব্য সংস্কৃতিকে হাজার বছরের নামে চালিয়ে দিয়ে এই উৎসবে শামিল হতে চায়?

আমি যেটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বেশিরভাগ মানুষ লাফালাফি করার জন্য একটা উপলক্ষ চায় মাত্র। একটা ছুতো পেলেই হল। ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, ভুল-শুদ্ধ, ধর্মীয়-বিধর্মীয় ইত্যাদি ব্যাপার গুলো তাদের কাছে তখন ভাত পায়না। আনন্দ করাটাই তাদের কাছে আসল। কারো জন্মদিনেও আনন্দ করে, ফাঁসির সংবাদেও আনন্দ করে। তারা ঈদেও খুশি আবার বড়দিনেও খুশি। আপনার কোন যুক্তি তারা মানবেনা। আপনার কোন কথা তারা শুনবেনা। এরাই পৃথিবীতে সংখ্যায় বেশি। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে অসম্ভব দুর্বল। এরা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে শুধু।

ইসলামের সাথে পহেলা বৈশাখ উদযাপন কেন সাঙ্ঘর্ষিক এই ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক ভাই চমৎকার সব আর্টিকেল লিখেছেন অনেক আগেই। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি তাই এখানে কোন কথা বাড়াবো না। ‘হ্যামেলিনের ইঁদুর’ শিরোনামে আমি সেই সব ব্যাপারগুলোই আলোচনা করি যেগুলোর আসারতা কুরআন এবং সুন্নাহের দলীল ছাড়াই সুস্পষ্ট।

আমি বলছিনা আপনি পহেলা বৈশাখ পালন করবেন না কারন সেটার বয়স মাত্র পঞ্চাশ বছরের মত বলে। হাজার বছর হোক আর পঞ্চাশ বছর হোক, কোন বিজাতীয় উৎসব বা জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কোন সংস্কৃতি একজন মুসলিমের জীবনের অংশ হতে পারেনা। তার জন্য উৎসবের দিন বছরের দুটোই।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাতে আগমন করলেন, আর মদীনাবাসীর দুটি দিন ছিল যাতে তারা বিনোদন বা খেলাধুলা করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “এই দিন দুটি কী?” তারা বলল, ‘আমরা এই দিনে জাহিলি যুগে খেলা ধুলা করতাম।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “মহান আল্লাহ তোমাদেরকে এই দিন দুটির পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। আর তা হলো ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আযহার দিন।” [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৪]

মদীনাতে আগমন করে, মদীনাতে বসাবাস করে মদীনার একটা অংশ হয়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘জাহেলি যুগের সংস্কৃতির’ সাথে একত্ব পোষন করেননি বা নিজেকে সেই সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করেন নি। আমার তবে সুযোগ কোথায়?

আমি রাসূলের দলে আমি তাই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করিনা। আপনি নিজেকে তাঁর দলের কেউ মনে করলে এসব সংস্কৃতি থেকে বেঁচে থাকুন।

আল্লাহ সুবহান ওয়া তায়ালা আমাদের সবাইকে জানা-অজানা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দিন।


[১] Causal Relationship/Causality/Causation is the relation between an event (the cause) and a second event (the effect), where the first event is understood to be responsible for the second.

[২] Correlation refers to any of a broad class of statistical relationships involving dependence.

[৩][৫][৭][৯] https://bn. banglapedia.org/index.php?title=পহেলা_বৈশাখhttps://bn.wikipedia.org/wiki/পহেলা_বৈশাখ

[৪] https://bn.banglapedia.org/index.php?title=পুণ্যাহ

[৬][১২] https://bn.wikipedia.org/wiki/পহেলা_বৈশাখ

[৮][১০][১৩][১৪][১৫][১৬][১৭][১৮] https://bn. banglapedia.org/index.php?title=পহেলা_বৈশাখ

[১১] https://bn.banglapedia.org/index.php?title=ছায়ানট

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

One Response

  1. Shahnaz

    love it – great read!… JazakAllahu khayr for a beautifully written article.

    Reply

Leave a Reply to Shahnaz Cancel Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive