প্রশংসা আল্লাহ্ সুবহানহুয়া তা’আলার, শান্তি বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের উপর। আবারও প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি আমাকেও তাঁর (সা.) অনুসারীদের অন্তর্গত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা প্রদান করায়।

▪ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তৎকালীন আরব সমাজের যে বিষয়টার বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলেন তা হলো আরববাসীদের বাপ-দাদা থেকে শুরু হওয়া নতুন কিছু প্রথা। আর ঐসব প্রথার মধ্যে ছিলো শিরক, কুসংস্কার ও অনাচার। তাই এই প্রথা নির্মূল করে সত্যিকার আদর্শ বাস্তবায়নই ছিলো তাঁর দায়িত্ব। আর তিনি তাঁর পুরো নবুওয়াত জীবনেই এই দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করেছেন এবং স্থাপন করেছেন শ্রেষ্ঠ আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব (আলহামদুলিল্লাহ্)। কখনো প্রথা নামে চলে আসা শিরক, কুফরীর নিকট মাথা নত করেন নি। বরং আদর্শের বলে এগুলোকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করেছেন।

IIRT Arabic Intensive

▪ যেহেতু বিষয়টা ‘পহেলা বৈশাখ’, তাই আগে একেই ক্লিয়ার করা উচিত। অর্থাৎ এটা কি আদর্শ নাকি প্রথা? তবে বুঝার সুবিধার্তে বলে রাখি ‘আদর্শ’ এমন বিষয়, যা সবাইকে মেনে নেয়ার কিংবা অনুসরণের আহ্বান করতে পারে। পক্ষান্তরে ‘প্রথা’ এমন এক বিষয় যা কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিশেষ কিছু আচরণ। আশা করি এখন বুঝতে সহজ হবে, ‘পহেলা বৈশাখ’ আসলে কি আমাদের আদর্শ নাকি একটি প্রথা বৈ অন্য কিছুই নয়।

“আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।”[১]  

উপরে উল্লিখিত দুই লাইন লিখা পড়েই বুঝতে পেরেছেন পহেলা বৈশাখ কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে বেষ্টন করেই উদযাপিত হয়। কখনো বৃটিশদের বিজয় কামনা, কখনো কৃষকদের খাজনা আদায়, কখনো কিছু কুসংস্কার চর্চা, আবার কখনো নিছক বিনোদনের জন্যই উদযাপিত হয়। আরো একটা বিষয় এই যে, প্রথাকে ইচ্ছে হলেই পরিবর্তন করা যায়। এই যেমন সম্রাট আকবরের নববর্ষ এখন আধুনিক নববর্ষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আদর্শের ক্ষেত্রে এমন হয় না। এই যেমন, নবী মুহাম্মদ (সা:) কে আদর্শ মেনে কেউ পূজায় শুভেচ্ছা জানায় না, কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে ছয় ওয়াক্ত বলে না। যদি এমনটা কেউ বলে, তাহলে বুঝে নিতে হবে এটা মুহাম্মদের (সা:) আদর্শ নয়, বরং নতুন আদর্শ। অর্থাৎ আদর্শকে পরিবর্তন করা যায় না, কিন্তু প্রথাকে ইচ্ছানুযায়ী বাড়ানো-কমানো যায়। আর এখানেই লড়াই।

▪ এবার আসুন জেনে নেই, পহেলা বৈশাখ’কে ঘিরে রাষ্ট্রীয় ভাবে পালিত হওয়া কিছু প্রথা:

মঙ্গল শোভাযাত্রা: ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো নয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।

বউমেলা: ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। বউমেলায় কাঙ্ক্ষিত মানুষের খোঁজে কাঙ্ক্ষিত মানসীর প্রার্থনা কিংবা গান্ধর্ব প্রণয়ও যে ঘটে না সবার অলক্ষে, তা কে বলতে পারবে।

ঘোড়ামেলা: এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।

উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন প্রচলিত এই প্রথা আপনার আদর্শের (ইসলামিক জীবনব্যবস্থার) সাথে কতটা সাংঘর্ষিক? আর ইসলামের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ কতটুকুই গ্রহণযোগ্য হতে পারে! যেখানে আপনার আদর্শ শিক্ষা দেয় মূর্তি পূজা, মানুষ পূজা, পশু পূজা ও প্রথা পূজাকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার নিকট মাথা নত করতে হবে, সেখানে কি করে আপনি কিছু মূর্তি আর প্রথার নিকট নিজেকে বিসর্জন দিবেন?

প্রশ্ন দুটি ভাবার পূর্বে নিজের আদর্শের (ইসলামের) প্রতি যথেষ্ট সম্মানবোধের ইচ্ছা রাখুন। কারণ আদর্শের জন্য লড়াই করে কিছু পেতে পারেন, কিন্তু প্রথার জন্য লড়াই করে সবই হারাবেন। কারণ আপনার আদর্শ যদি হয় ইসলাম, তাহলে এর প্রতিদান জান্নাত পর্যন্ত। আর আপনি যদি বাপ-দাদার সৃষ্ট প্রথাকে আদর্শ মনে করার মতো চরম ভুল করেন, তাহলে জেনে রাখুন মানুষের হাতে গড়া প্রথা মানুষেই ভেঙ্গে দেয়। যেমনটি ভেঙেছেন পিতা ইবরাহীম (আ:) ও নবী মুহাম্মদ (সা:)। আর যা মানুষের হাতেই স্থায়ী পরাজয় বরণ করে, তা কখনো আখিরাতে উপকারে আসতে পারে না।

▪ এবার আসি পহেলা বৈশাখকে ঘিরে কিছু সামাজিক ও পারিবারিক কুসংস্কার এর দিকে:

– এই দিনে ভালো কিছু খাইলে, সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে। (একটি কুসংস্কার বৈ কিছুই নয়)

– এই দিনকে ঘিরে মেলার আয়োজন করা। (এমতাবস্থায় পুরো মেলা জুড়েই চলে জুয়া, নাচ সহ আর বিভিন্ন নোংরামী বিষয়)

– এই দিনে ভালো কিছু করলে, সারা বছর ভালো কাজ করা যাবে। (অথচ ভালো কাজের শিক্ষক নবী মুহাম্মদ (সা:) এর জীবদ্দশায় পহেলা বৈশাখের অস্তিত্ব ছিলো না)

এছাড়াও এই দিনকে ঘিরে ব্যক্তি পর্যায়ে রয়েছে নানা নোংরামীর আয়োজন! এই যেমন একটি ছেলে একটা মেয়েকে নিয়ে সকাল নয়টায় বাসা থেকে বের হয়ে সারাদিন শতশত মানুষের ভিড়ে বটমূল, মেলা আর কনসার্ট উপভোগ করে আসলো! বলেনতো ঐ সময়টাতে মেয়েটার ইজ্জত-সম্মানের নিরাপত্তা কে দিবে? ভাবছেন শরীর ঢাকার জন্য যথেষ্ট কাপড় তো পরিধান করছেই? তাহলে শুনুন- ইজ্জতকে যেমন ওজন করা যায় না, একে হনন করতে পুরোপুরি স্পর্শ করারও প্রয়োজন হয় না। দু চোখের হিংস্র দৃষ্টি আর জিহ্বার বিকৃত নড়াচরা দিয়েই তা ছিনিয়ে নেওয়া যায়। কি করে বুঝাই! একটা বেপর্দা মেয়ে তার (বখাটে) বন্ধু মহলে রীতিমতো একজন প্রস্টিটিউট হিসেবেই আলোচিত হয়। হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্টই হবে! তবে তা কতটা সত্য তা দেখতে চার-পাঁচটা বখাটের সিগারেট পার্টিতে কান দিলেই বুঝতে পারবেন, একটু আগে যে মেয়েটাকে ‘হাই দোস্ত’ বলে এসেছে, সেই মেয়ের উপরই তারা এখন লালা ফেলছে! আর গাঁজা-মদের আসরে তো তারা (বখাটেরা) পশুই হয়ে যায়। সেখান থেকে আপন বোনও রেহাই পাওয়া কষ্টকর!

এবার আপনিই বলুন ‘পহেলা বৈশাখ’ কি আপনার আদর্শে স্থান পাওয়ার ন্যুনতম যোগ্যতা রাখে? যদি উপরের বিষয়গুলো মাথায় থাকে, তাহলেতো প্রশ্নের আগেই উত্তর চলে আসবে। অর্থাৎ এটা কখনোই আদর্শের দাবি রাখে না। বরং এই প্রথায় এমন কিছু রয়েছে যা আমাদের আদর্শের (ইসলামের) বিপরীত। তাই যারা ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের উচিত এই ‘প্রথা আর আদর্শের দ্বন্দ্বে’ আদর্শকে মজবুত করে আকড়ে ধরা। কারণ এই লড়াই কিয়ামত অবধিই চলবে। তবে দিন শেষে আদর্শই (ইসলামই) জয়ী হবে। আর শেষ হাসিটুকু তো তাঁরাই হাসবে যারা আদর্শের (ইসলামের) জন্যে লড়ে।

এখন নিজেকে আবার প্রশ্ন করুন- ইসলামের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ কতোটা বৈধ? আর মুসলিমরা কি পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পারে? যেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো শিরক আর নানারকম কুসংস্কার স্থান পেয়েছে! যা কিনা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।

▪ সবশেষে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা:) দুটি বানী দিয়ে শেষ করছি –

– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনা বাসীদের দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত৷ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু দিনের কি তাৎপর্য আছে? মদিনা বাসীগণ উত্তর দিলেন: আমরা মূর্খতার যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম৷ তখন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহিও য়াসাল্লাম বললেন: ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন৷ তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর৷’ [সুনান আবু দাউদ]

– “এবং যে কেউই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা আকাঙ্খা করবে, তা কখনোই তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না, এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন ৷” [সূরা আলে ইমরান(৩): ৮৫]


[১] https://bn.wikipedia.org/wiki/পহেলা_বৈশাখ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive