প্রারম্ভিকা

এই লেখাটাতে সায়েন্সের সাথে আমার, আপনার এবং স্রষ্টার একটা সংযোগ ঘটানো হয়েছে। আমাদের ক্লাসগুলোতে সায়েন্সের গাদা গাদা বোরিং তথ্য দেয়া হয় শুধু, পেছনের দর্শনটা কেউ শেখায় না আর। এটা পড়ার পর হয়তো আপনি নিজে নিজেই বিজ্ঞানের নতুন কিছু জানার সাথে সাথে ভেবে বের করে ফেলতে পারবেন এটার সাথে আপনার সম্পর্কটা কি এবং নিজের জীবনটাকে কিভাবে যাপন করা উচিৎ! সবকিছুর মাঝে একটা রিলেশান তৈরী করে ফেলে বেশ মজা পাবেন।

এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলুন। পড়া শেষে ভালো লাগবে ইন শা আল্লাহ। কমেন্টে আপনার মূল্যবান মতামত জানালে ভালো লাগবে।

IIRT Arabic Intensive

‪‎গোবরনামা‬

১০০ বছর আগের একটা ফটো সামনে তুলে ধরা হলো। গোবরের ফটো বলে মনে হচ্ছে। দূরে আউট অফ ফোকাসে একটা গোয়াল ঘর, এবং অনেকগুলো গরুও দেখা যাচ্ছে। তাতেই অবশ্য প্রমাণিত হয়ে যায় না যে এটা গোবরের ফটো। যেহেতু এটা অতীতের ঘটনা, এবং ঘটনাটা ঘটার সময়ে আমি সেখানে ছিলাম না, সেহেতু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে এটা “গোবর”। এক্ষেত্রে এখন যে উপাত্তগুলো (Data) আমার কাছে আছে তার উপর ভিত্তি করেই আমাকে অতীতের সেই ঘটনার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

আমার সারাজীবনের (২৫ বছরের) পর্যবেক্ষণ থেকে যে পরিমাণ উপাত্ত আমার মাথায় জড়ো হয়েছে, তা থেকে আমি বুঝতে পারছি যে এটা হাঁস কিংবা বিড়ালের বিষ্ঠা হতেই পারে না। হাতির হওয়াও সম্ভব না। এটা ম্যাচ বাক্স, কম্পিউটার, মানুষ কিংবা টর্চ লাইটের ছবিও না আমি নিশ্চিত। কারণ, এতোদিনের পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার সাথে মিলছে না। তবে হ্যাঁ, ষাঁড়ের হতে পারে। আবার দূরে যেহেতু গোয়াল ঘর আর গরু দেখা যাচ্ছে তাহলে ওই গরুগুলোরও হতে পারে। তবে রঙ, আকার-আকৃতি দেখে এইটুকু নিশ্চিত যে এটা গরু জাতীয় কোন অসভ্য প্রাণীরই কুকর্ম!

এই সিদ্ধান্তে আসতে আমার অতীতে উপস্থিত থাকতে হয়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণও করতে হয়নি। ঘটনাটা যেহেতু অতীতের, ফলে আমি নিজে এক্সপেরিমেন্ট এবং পর্যবেক্ষণ করিনি, এবং তা সম্ভবও নয়। শুধুমাত্র উপাত্ত এবং অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে আসার এই সায়েন্সটাকে বলা হয় Historical Science. এইখানে শুধু Effect (গোবর) দেখেই তার পেছনের আসল Cause টা (গরু জাতীয় প্রাণী) কী ছিলো সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্তে চলে আসা যায়।
এটাই নিয়ম।

‪‎তোমার তিনটা ঘটনা‬

১ম ঘটনাঃ তোমার ফোনে লাস্ট যে মেসেজটা এসেছিলো সেটা পড়ে কি মনে হয়েছিলো? মেসেজটাতো পড়ে বুঝতে পেরেছিলে, নাকি? এটাতো নিশ্চিত যে মেসেজটা তোমাকে এমন একজন পাঠিয়েছে যে পড়তে এবং লিখতে জানে। জানে কিভাবে মেসেজ পাঠাতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটার পেছনে একটা বুদ্ধিমান সত্ত্বার অস্তিত্ব রয়েছে এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই তোমার কোন সন্দেহ নেই! তুমি বুদ্ধিমান হলে সন্দেহ থাকার কথা না আর কি! হেহেহেঃ

অথচ মেসেজটা একটা ইঁদুর লিখেছে কিনা তুমি তা দেখোনি। তুমি সেখানে ছিলে না। পর্যবেক্ষণও করোনি। তবুও তুমি নিশ্চিত এটার (effect) পেছনে কোন বুদ্ধিমত্তাকে (cause) থাকতেই হবে।

এবার দ্বিতীয়ঃ আমি যদি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করতে করতে গলা ফাটিয়ে দিনরাত বলতে থাকি-
“Angry Birds” গেইমসটার পেছনে কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত নেই, সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতিতে এলোমেলোভাবে (random) নিজে নিজেই এটা তৈরী হয়ে গেছে। শুধু তাই না, যে এন্ড্রয়েড ফোনে গেইমসটা চলছে সেটা স্যামসাং কোম্পানী বানায়নি। বরং সেটাও প্রকৃতিতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর থাকার ফলে তৈরী হয়ে গেছে। এমনকি এর গায়ে খোদাই করা স্যামসাং কথাটাও এইভাবেই এসেছে।

আমি তোমাকে হাজার যুক্তি দিয়ে বুঝালেও তুমি এটা মেনে নিবে না। আমাকে পাগল ভাববে, ঠিক? কারণ, তুমি জানো সামান্য স্যামসাং শব্দটাও ফোনের গায়ে খোদাই হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মিলিয়ন মিলিয়ন বছরেও না। অসম্ভব। এন্ড্রয়েড ফোন নিজে নিজে তৈরী হয়ে যাওয়াতো অনেক অনেক দূরের কথা।

আর গেইমসটার পেছনে যে হাজার হাজার লাইনের প্রোগ্রামিং কোড লেখা হয়েছে প্রোগ্রামিং এর ভাষা দিয়ে, এবং সেটা যে অন্ততপক্ষে একজন দক্ষ বুদ্ধিমান প্রোগ্রামার ছাড়া হওয়া কোনদিনও সম্ভব না, এটা তুমি ভালোভাবেই জানো। আমি যতই আউল ফাউল যুক্তি দিই, প্রোবাবিলিটির অংক কষে তোমাকে দেখাই, তুমি যে টলবে না সেটা আমি নিশ্চিত।

অথচ ফোন কিংবা গেইমসটা প্রস্তুত হয়েছে অনেক আগে। অতীতে। তুমি দেখোনি এটা কিভাবে প্রস্তুত হয়েছে। তবুও তুমি অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত জানো এই ফোন আর গেইমসের (effect) পেছনে অনেকগুলো বুদ্ধিমত্তার পরিশ্রম (cause) জড়িত।

৩ নং গল্পঃ আমার বিড়ালটাকে কী-বোর্ডের উপরে ছেড়ে দেয়ায় সে তার উপর কিছুক্ষণ এলোমেলো দৌড়ালো। খটাখট করে অনেক কিছু টাইপ হয়ে গেলো খুলে রাখা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ফাইলটাতে। বিড়ালটাকে নামিয়ে ফাইলটাকে “Random” নামে সেইভ করলাম। এবার আমি বিড়াল নিয়ে একটা রচনা লিখলাম টাইপ করে। ফাইলটাকে “Essay” নামে সেইভ করলাম। দুইটা ফাইলেরই সাইজ হলো 50 KB.

এরপর তোমাকে ঘাড় ধরে এনে আমার কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে ফাইল দুটো দেখিয়ে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বললাম, “ঠিক করে বল ব্যাটা, কোন ফাইলটা আমি টাইপ করেছি? এখানে একটা আমার টাইপ করা, আরেকটা আমার বিড়ালের।”

কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইল দুটো ওপেন করেই তুমি বুঝে যাবে “Essay” ফাইলটা আমার টাইপ করা। কেনো? কারণ, তুমি দেখতে পাচ্ছো যে এখানে প্রতিটা অক্ষর সাজিয়ে অর্থপূর্ণ শব্দ লেখা হয়েছে। শব্দগুলোকে সাজিয়ে বাক্য সাজানো হয়েছে। বাক্যগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে সেগুলো এক একটা অর্থবোধক অনুচ্ছেদ তৈরী করেছে। সবগুলো অনুচ্ছেদ মিলে একটা রচনা তৈরী করেছে। এটা কোনভাবেই আমার বিড়ালের পক্ষে করা সম্ভব না। এরকম সাজানো গুছানো রচনার নিশ্চয়ই কোন বুদ্ধিমত্তার হাত রয়েছে। যেহেতু এখানে অপশান মাত্র দুইটাঃ আমি আর আমার বিড়াল, সেহেতু এটা নিশ্চিত যে রচনাটা আমারই লেখা।

ঠিক?

টাইপ হওয়ার সময় তুমি সেখানে ছিলে না। ঘটনাটা অতীতে ঘটেছে। পর্যবেক্ষণ না করেও “Essay” ফাইলটার (effect) পেছনে যে বিড়ালটার জায়গায় আমার অবস্থানই (cause) বেশি যুক্তিযুক্ত, এটা তুমি কিভাবে জানো? তোমার এতোদিনের পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা থেকে।

বেশতো তিনটা ঘটনা একটানা পড়ে ফেললে। এবার একটা সিদ্ধান্তে আসা যাক। কি বলো?

‪সিদ্ধান্ত‬

মেসেজ, গেইমস, কিংবা ফাইলটাতে আসলে কি ছিলো?
ছিলো Information।

ইনফর্মেশান বা তথ্য আছে কিভাবে বুঝলাম? বুঝলাম কারণ, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রতিটা ঘটনাই অর্থপূর্ণ উপাত্ত এবং জ্ঞান বহন করছিলো। তথ্য বহন করছিলো। এবং আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবসময়েই জানি যেকোন অর্থপূর্ণ ইনফরমেশান বা তথ্যের পেছনে বুদ্ধিমত্তার উপস্থিতি থাকতেই হবে।

উপরের অংশটুকু Science। এই সায়েন্স আমার লাইফে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে যদি আমরা ভাবি, এবং এর পেছনের দর্শনটুকু উপলব্ধি করতে পারি।

যদি আমরা নিজেদের দিকে, নিজেদের চারপাশের জগতের দিকে তাকাই, ভাবি, তাহলে আমরা অবাক হয়ে যাবো। আমরা জানি যে, প্রতিটা প্রাণীর একদম গাঠনিক একক হচ্ছে কোষ। সেই কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা DNA তে A, T, G, C নামের চারটা অক্ষর দিয়ে সাজানো আমাদের পুরো শরীর কেমন হবে তার ব্যাপারে তথ্য। আজিব না?

এই ডি এন এ তেই লেখা আছে আমার নাক কেমন হবে, কান কেমন হবে, চোখের রঙ কেমন হবে, চুল কি কোঁকড়ানো হবে, নাকি সোজা! এই যে আমার এতো জটিল মস্তিস্ক থেকে শুরু করে জটিল হৃদপিন্ড, চোখ, ফুসফুস, কিডনী এসব কিন্তু যাত্রা শুরু করেছে আমার আব্বু আর আম্মুর দুইটা ছোট্ট কোষের মিলন (fertilization) থেকে। এই কোষগুলোতে ছিলো ডি এন এ, যাতে লেখা Genetic Code অনুযায়ী পরবর্তীতে টিস্যু এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো তৈরী হয়েছে। সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো একত্রিত হয়ে এক একটা সিস্টেম তৈরী করেছে (যেমন নার্ভাস সিস্টেম, ডাইজেস্টিভ সিস্টেম, ইউরিনারী সিস্টেম ইত্যাদি)। সবগুলো সিস্টেম আবার একসাথে কাজ করার ফলেই তৈরী হয়েছে আমার পুরো শরীর। যে শরীরটা ব্যবহার করে আমি এখন লিখছি, আর তুমি পড়ছো।

এই যে ডি এন এ তে Genetic Code লেখা আছে, যেটা আমার শরীরের গঠন কেমন হবে না হবে তার পুরোটাই ঠিক করে দিচ্ছে এটা কি প্রথম কোষটাতে এমনি এমনি চলে এসেছে? অর্থবোধক একটা মেসেজ, একটা প্রোগ্রামিং কোড এবং একটা গোছানো রচনা নিজে নিজে আসতে পারে না এটা তুমি জানো। ডি এন এ কিন্তু প্রোগ্রামিং কোডের মতোই Genetic Code বহন করে। বহন করে অর্থপূর্ণ মেসেজ, যে মেসেজ বলে দেয় একটা প্রাণ কিভাবে রচিত হবে।

একটা প্রাণীর শরীর তো অনেক অনেক জটিল ব্যাপার। সেটার কথা বাদ দিয়ে যদি তার ভেতরে থাকা ডি এন এর ভাষা, সজ্জা এবং অর্থবহতার দিকে তাকাই তাহলে এই ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না যে এর পেছনে একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বা (Intelligence) রয়েছেন।

সেই বুদ্ধিমান সত্ত্বা কিন্তু নিজেকে সবকিছুর স্রষ্টা দাবী করে আরো একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন আমাদের ম্যানুয়াল হিসেবে। চলার পথ হিসেবে। জীবনকে যাপনের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হিসেবে। সেই পদ্ধতি যে শুধু থিওরিটিক্যাল না, প্র্যাকটিক্যালও, সেটারও প্রমাণ দিয়েছেন তাঁর বার্তাবাহকের ﷺ মাধ্যমে।

আচ্ছা, এবার নিজেকে একটা প্রশ্ন করি।
আমরা সেই মেসেজ অনুযায়ী নিজেদের পুরো জীবনটাকে যাপন করছিতো?

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

About The Author

আমি মুহাম্মাদ তোয়াহা আকবর। একাডেমিক পরিচয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন বায়োটেকনোলজিস্ট। আগ্রহ বিজ্ঞানে এবং গবেষণায়। তারচেয়েও বেশি আগ্রহ পড়ানোতে। নৈতিক এবং আদর্শিক জীবনে একজন মনেপ্রাণে মুসলিম। নাস্তিকতা ছেড়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অশেষ করুণা আর দয়ায় ইসলামের আলো চিনে এ পথে আসতে পেরেছি ২০১২ তে। এখন শিখছি। আরো বহু দূর পথ পাড়ি দিতে হবে জানি। অনন্তের জীবনের পাথেয় কুড়োতে বড্ড দেরী করে ফেলা একজন দূর্ভাগা হিসেবে নয়, বাঁচতে চাই সোনালি দিন গড়ার প্রত্যয়ে। ক্ষণিকের বালুবেলায় যে কটা মুক্তো কুড়োতে পারি সেই তো আমার লাভের খাতার শব্দমালা। হাঁটার পথে একটা দুটো মুক্তোর কথা, উপলব্ধির কথা লিখবো বলে এখানে পতাকা পুঁতেছি। আমি থাকবোনা একদিন। আমার খুঁজে পাওয়া কিছু মুক্তো হয়তো থেকে যাবে প্রজন্ম ছুঁয়ে প্রজন্মে। হয়তো হবে কারো আলোর মশাল। আর সে আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে।

Related Posts

Loading Facebook Comments ...

5 Responses

  1. Maruful Islam

    সুবহান’আল্লাহ… চমৎকার হয়েছে ভাই…আল্লাহ আপনাকে আরো জ্ঞান দান করুক।

    Reply
  2. Rony

    অসাধারন…ভাই নিয়মিত আপনার লেখা চাই

    Reply
  3. Mohammad Islam

    সহজ ভাষায় সুন্দর লেখা। জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive