দাসপ্রথার নিন্দা বা দাসপ্রথার বিলুপ্তি না করে দাসের উপর স্বাধীন মানুষের প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষ সমর্থনের অর্থ কী?

খ্রিষ্টধর্মের প্রচারক ও দ্বীনে ইসলামের প্রচার-প্রসারে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের পক্ষ থেকে দাসপ্রথা সম্পর্কিত আলোচনা করা এবং সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়টি বিবেকবান মানুষের অন্তরে ভাবান্তর সৃষ্টি করে। আর এসব প্রশ্নের আড়ালে প্রকৃত গোপন উদ্দেশ্যসমূহের প্রতি অভিযোগের আঙুল উঠা স্বাভাবিক।

IIRT Arabic Intensive

এই দাসত্ব প্রথাই ইয়াহূদী এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে নির্যাতনীয় পন্থায় স্বীকৃত ও প্রমাণিত; আর তাদের কিতাবসমূহে এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এবং পরিপূর্ণভাবে তার স্বচ্ছন্দ অনুমোদন রয়েছে। সুতরাং তাদের যে বিষয়টি প্রথমেই দৃষ্টির সামনে পড়ে তা হলো: কীভাবে খ্রিষ্টান গির্জাসমূহ মানুষদেরকে খ্রিষ্টান বানানোর দাওয়াত দিতে পারে, যেখানে খোদ খ্রিষ্টধর্মই দাসত্ব প্রথা ও তা বিধিসম্মত হওয়ার কথা বলে? অন্য অর্থে বলা যায়; কীভাবে তারা এই ব্যাপারটি নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করছে, অথচ তারা তাতে কান বরাবর ডুবে আছে?

আর ইসলামে দাসপ্রথার বিষয়টিকে যদি উভয় ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে এবং ইসলাম আগমনের সময়ের দাসপ্রথার সাথে তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করা হয়, তবে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে প্রতিভাত হবে।

আর কোনো গবেষক যখনই দেখে এসব প্রশ্ন, যেগুলোতে খ্রিষ্টান মিশনারিরা তাদের ভাষাকে ব্যাপকভাবে তাদের সাধ্যমতো কাজে লাগিয়েছে যাতে তারা ইসলামকে অপমান করতে পারে; তখন সে গবেষক এই বিষয়ে ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান ও আধুনিক সভ্যতার নিকট যা আছে, সে দিকে ইঙ্গিত দিয়ে ব্যাপকভাবে অবশ্যই কথা বলবে। অতঃপর ইসলামে যা কিছু আছে, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। ইসলাম এ ব্যাপারে অনেক মিথ্যা অভিযোগ ও অপবাদের সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে অপরাধে ডুবে থাকা কিছু শক্ত অপরাধী মুক্তি পেয়ে গিয়েছে; এমনকি দুঃখজনকভাবে তাদের দিকে অভিযোগের আঙুল দিয়েও ইঙ্গিত করা হয়নি!

ইসলাম ও দাসপ্রথা:

ইসলাম স্বীকৃতি দেয় যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল করে সৃষ্টি করেছেন, তার উপর শারি‘আতের দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়েছেন এবং এগুলোর ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছা ও পছন্দের উপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। আর এই ইচ্ছাকে সীমাবদ্ধ করা অথবা এই পছন্দকে হরণ করার কোনো অধিকার কোনো মানুষের নেই। আর যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে দুঃসাহস করবে, সে হবে যালিম ও সীমালঙ্ঘনকারী।

এই বিষয়ে এটা ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান ও মূলনীতি। আর যখন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে: কীভাবে ইসলাম দাসপ্রথাকে বৈধতা দেয়?

তার জবাবে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে ও নির্দ্বিধায় বলবো: দাসত্ব প্রথা ইসলামে বৈধ; কিন্তু ইনসাফের দৃষ্টিভঙ্গি ও সত্য উৎঘাটনের লক্ষ্য থাকলে দেখতে হবে দাসপ্রথার উৎস ও কারণসমূহ বিশ্লেষণপূর্বক ইসলামে দাসপ্রথার খুঁটিনাটি বিধানসমূহ; অতঃপর আরও দেখতে হবে দাস-দাসীর সাথে আচার-ব্যবহার, অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে স্বাধীন ব্যক্তির সাথে তার সমতা বিধান; স্বাধীনতা ও মুক্তি লাভের পদ্ধতি এবং শারি‘আতে এর বহু ধরনের দরজার কথা; বিশেষ করে যখন এসব পদ্ধতির সাথে অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়াও স্মরণে রাখতে হবে সভ্যতা, আধুনিকতা ও প্রগতির চাদরে আবৃত এই পৃথিবীর নতুন ধরনের দাসপ্রথার কথা। এখানে পাঠক লক্ষ করবেন যে, আমি এ বিষয়ের উপর অনেক পরিমাণে আল-কুরআনুল কারীমের বক্তব্য এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য ও নির্দেশনার সাহায্য গ্রহণ করবো— এর গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এবং এ কথা জোর দিয়ে বলার জন্য যে, ত্রুটিপূর্ণ কাজকর্ম দ্বারা ইসলামকে বিচার-বিশ্লেষণ করা বৈধ নয়।

আর এই ব্যাপারে আমরা বলবো: ইসলাম দাস-দাসীর ব্যাপারে যে চমৎকার অবস্থান গ্রহণ করেছে, অন্য কোনো গোষ্ঠী বা ধর্মের কেউ সে অবস্থান গ্রহণ করেনি। আর এই দাসপ্রথা সম্পর্কিত সকল বিষয় যদি এই নিয়ম-নীতির আলোকে চলতো, তবে কখনো সৃষ্টি হতো না এসব সমস্যা, যেগুলোর মূলে রয়েছে অপহরণ, ছিনতাই, বলপ্রয়োগ অথবা যে কোনো ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে প্রাচীন ও আধুনিক কালে স্বাধীন ব্যক্তিকে দাস বানানো। এর ফলেই দাসপ্রথার বিষয়টি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে ও নিকৃষ্ট পদ্ধতিতে এত কলঙ্কিত বিষয়ে রূপ নিয়েছে। মূলত দাসপ্রথা এই অপহরণ পদ্ধতির মাধ্যমেই পৃথিবীর সকল মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। বরং এ পদ্ধতিই বিগত শতাব্দীগুলোতে ইউরোপ ও আমেরিকায় দাসপ্রথার বড় উৎস ছিলো।

আর ইসলাম এই ব্যাপারে তার বক্তব্যসমূহের মাধ্যমে দৃঢ়সঙ্কল্প ও চূড়ান্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। এক হাদীসে কুদসীর মধ্যে এসেছে:

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আমি কিয়ামাতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ হবো, তাকে পরাজিত করবোই। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি হলো এমন, যে আমার নামে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং শপথ করে, অতঃপর তা ভঙ্গ করে। আরেক ব্যক্তি হলো যে স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে, অতঃপর তার বিনিময় ভক্ষণ করে। আর তৃতীয় আরেক ব্যক্তি হলো যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে, অতঃপর তার থেকে পুরাপুরি কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না।” (বুখারী, কিতাবুল বুয়ূ, বাব নং- ১০৬, হাদীস নং- ২১১৪)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

“তিন শ্রেণীর মানুষের সালাত (নামায) আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন না; এক ব্যক্তি হলেন যিনি কোনো সম্প্রদায়ের ইমামতি করেন, অথচ ঐ সম্প্রদায়ের লোক তাঁকে অপছন্দ করে। আরেক ব্যক্তি হলো যে সালাতের ওয়াক্ত অতিবাহিত হলে সালাত আদায় করতে আসে এবং তৃতীয় আরেক ব্যক্তি হলো যে স্বাধীন ব্যক্তিকে ধরে গোলামে পরিণত করে।” — (আবূ দাউদ, সালাত অধ্যায়, বাব নং- ৬৩, হাদীস নং- ৫৯৩ ; ইবনু মাজাহ, কিতাবু ইকামাতিস সালাত ওয়াসসুন্নাতু ফীহা, বাব নং- ৪৩, হাদীস নং- ৯৭০ ; তাঁরা উভয়ে আবদুর রহমান ইবন যিয়াদ আল-ইফরিকীর বর্ণনা থেকে বর্ণনা করেন)।

মজার ব্যাপার হলো, আপনি আল-কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যসমূহের মধ্যে এমন একটি বক্তব্যও খুঁজে পাবেন না, যা মানুষকে দাস-দাসী বানানোর কথা বলে; কিন্তু আল-কুরআনের আয়াত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যসমূহ থেকে শতাধিক বক্তব্যের সমাবেশ আছে, যেগুলো দাসকে গোলামী থেকে মুক্তি ও আযাদী দিতে আহ্বান করে ও উৎসাহিত করে।

ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় দাসত্বের উৎস ছিলো বহু রকমের; কিন্তু দাসত্ব থেকে মুক্তির কোনো পদ্ধতি ও উপায়-উপকরণ ছিলো না বললেই চলে। অতঃপর ইসলাম এসে তার শারি‘আত তথা নিয়ম-নীতির মধ্যে এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করলো; ফলে মুক্তি ও আযাদী অর্জনের বহু ক্ষেত্র তৈরি করলো এবং বন্ধ করলো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধকরণের অনেক পথ; আর অনেক অসিয়তের প্রবর্তন করলো, যা এসব পথকে বন্ধ করে দেয়।

দাসপ্রথার অন্যতম পদ্ধতি ছিলো বিভিন্ন যুদ্ধের সময়ে বন্দীকরণ পদ্ধতি। আর প্রত্যেক যুদ্ধেই আবশ্যকীয় ব্যাপার ছিলো যুদ্ধবন্দী। তখনকার দিনের স্বতঃসিদ্ধ প্রথা অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের মান-সম্মান ও অধিকার বলতে কিছু ছিলো না; আর তাদের সামনে ছিলো কেবল দু’টি পথ: হয় তাদেরকে হত্যা করা হতো, আর না হয় দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হতো।

কিন্তু ইসলাম এসে তৃতীয় এক পদ্ধতির প্রতি উৎসাহিত করলো; আর তা হচ্ছে: যুদ্ধবন্দীর সাথে উত্তম ব্যবহার করা ও তাকে মুক্ত করে দেওয়া। আল-কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“খাবারের প্রতি মহব্বত সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাবার দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই আমরা তোমাদেরকে খাবার দান করি, আমরা তোমাদের নিকট থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও না।”  [সূরাহ আল-ইনসান (৭৬): ৮ – ৯]

আয়াতটির মর্মস্পর্শিতা ও উৎসাহদান মন্তব্যের অবকাশ রাখে না। আর ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে বলেন:

“তোমরা যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দাও, ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দান কর এবং রুগ্ণ ব্যক্তিকে সেবা কর।” (বুখারী, কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার, বাব নং- ১৬৮, হাদীস নং- ২৮৮১)।

সর্বপ্রথম মুসলিম ও তাদের শত্রুগণের মধ্যে সংঘটিত বদর যুদ্ধে মুসলিমগণ বিজয় লাভ করেন এবং তাতে আরবের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক হয়। তারা বন্দী জীবনে নিপতিত হলো, যেমনিভাবে রোম ও পারস্য সম্রাটদের মতো গণ্যমান্য ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ বড় বড় রাষ্ট্রের যুদ্ধসমূহে যুদ্ধবন্দিত্বের শিকার হতো। যদি তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো, তবে তা তাদের জন্য যথাযথ হতো; কারণ তারা ইসলামী দাওয়াতের সূচনা লগ্নে মুসলিমদেরকে অত্যন্ত কঠিন কষ্ট দিয়েছিলো। কিন্তু আল-কুরআনুল কারীম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে দিকনিদের্শনা দিচ্ছে এইভাবে:

“হে নবী! তোমাদের করায়ত্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে বলো, আল্লাহ যদি তোমাদের হৃদয়ে ভালো কিছু দেখেন, তবে তোমাদের নিকট থেকে যা নেয়া হয়েছে, তা অপেক্ষা উত্তম কিছু তিনি তোমাদেরকে দান করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তারা তোমার সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করতে চাইলে, তারা তো পূর্বে আল্লাহর সাথেও বিশ্বাসভঙ্গ করেছে; অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তাদের উপর শক্তিশালী করেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-আনফাল (৮): ৭০ – ৭১]

এসব যুদ্ধবন্দীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তের শুরু থেকে এই যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত অধিকাংশ মুসলিমদের সাথে ভয়াবহ রকমের নির্যাতন ও নিপীড়নমূলক আচরণ করেছিলো। তারা চেয়েছিলো তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে অথবা তাদেরকে দখল করতে। তাদেরকে এমনি-এমনি খুব দ্রুত ছেড়ে দেওয়াটা কি আপনি উত্তম-নীতি বলে গণ্য করবেন??

জেনে রাখা দরকার যে, এই বিষয়টি রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের স্বার্থের সাথে জড়িত। এই জন্য আপনি দেখতে পাবেন যে, মুসলিমগণ বদরে[১] যুদ্ধবন্দীদের নিকট থেকে বিনিময় গ্রহণ করেছেন; আর মক্কা বিজয়ের দিন মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিলো:

“যাওতোমার আজ সকলেই মুক্ত।”

বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরাজিত গোত্রের এক যুদ্ধবন্দিনীকে বিয়ে করে ঐ বন্দিনীর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছিলেন; কারণ, তিনি ছিলেন ঐ সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের অন্যতম একজনের কন্যা। ফলে মুসলিমগণের সকলেই ঐসব যুদ্ধবন্দীদের সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

আর এ থেকেই দাসত্বের আশ্রয় নেওয়ার সীমিত পরিসর ও ক্ষুদ্র স্থানগুলো জানতে পারবেন। দাসপ্রথাকে একেবারে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়নি; কারণ, সত্য ও ন্যায়ের বিরোধী এই কাফির যুদ্ধবন্দী হয় ছিলো যালিম, অথবা যুলুমের সহায়তাকারী, অথবা যুলুম বাস্তবায়নের অথবা যুলুমের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের এক উপকরণ। তাই তার স্বাধীনতা ছিলো অন্যদের উপর তার সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি ও অহংকারের সুযোগ।

তবুও এর জন্য এবং অনুরূপ ব্যক্তিদের জন্য স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার সুযোগ ইসলামে অনেক এবং ব্যাপক। তেমনিভাবে ইসলামে দাস-দাসীদের সাথে আচার-আচরণ ও লেনদেনের পদ্ধতিসমূহে ন্যায়পরায়ণতা ও সম্প্রীতির সমাবেশ ঘটিয়েছে।

স্বাধীনতা লাভের উপায়-উপকরণসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম কতগুলো উপকরণ হলো: যাকাতের এক অংশ গোলাম মুক্তির জন্য নির্ধারণ; ভুলবশত হত্যার কাফ্‌ফারা, যিহার ও শপথের কাফ্‌ফারা; রমাদ্বানে ইচ্ছাকৃত রোযাভঙ্গের কাফ্‌ফারা। এছাড়াও রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় গোলাম মুক্তকরণে সাধারণভাবে সহানুভূতিমূলক আবেদন।

ঐসব দাস-দাসীদের প্রতি ন্যায় ও অনুকম্পার ভিত্তিতে কতিপয় কাঙ্ক্ষিত আচার-আচরণের সংক্ষিপ্ত উদাহরণ নিম্নে দেওয়া হলো:

১. তাদের মনিবদের মতো খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদের নিশ্চয়তা:

আবূ দাউদ র. মা‘রুর ইবন সুয়াইদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমরা ‘রবযা’[২] নামক স্থানে আবূ যরের নিকট উপস্থিত হলাম, অতঃপর দেখা গেলো যে, তাঁর গায়ে এবং তাঁর গোলামের গায়ে একই ধরনের চাদর। অতঃপর তিনি বললেন: হে আবূ যর! আপনি যদি আপনার গোলামের চাদরটা আপনার চাদরের সাথে মিলেয়ে ব্যবহার করতেন, তবে তা সুন্দর হতো; আর তাকে আপনি অন্য আরেকটি কাপড় পড়িয়ে দিতেন? তখন তিনি (আবূ যর) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন; সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যার ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়; আর সে যেন তাকে পোশাক হিসেবে তা-ই পরিধান করায় যা সে নিজে পরিধান করে এবং যে বোঝা বহন করতে সে অক্ষম, সে যেন এমন বোঝা তার উপর চাপিয়ে না দেয়। তার পরেও যে বোঝা বহন করতে সে অক্ষম, এমন বোঝা যদি তার উপর চাপিয়ে দেয়, তবে সে যেন তাকে সহযোগিতা করে।” (বুখারী, কিতাবুল আদব, বাব নং- ৪৪, হাদীস নং- ৫৭০৩)।

২. তাদের সম্মান রক্ষা করা:

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাওবার নবী আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“যে ব্যক্তি তার নির্দোষ গোলামকে অপবাদ দেবে, কিয়ামাতের দিন তাকে অপবাদের শাস্তি স্বরূপ বেত্রাঘাত করা হবে; তবে সে যা বলেছে তা যথাযথ হলে ভিন্ন কথা।” (বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, বাব নং- ৩১, হাদীস নং- ৬৪৬৬)।

ইবনু ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর গোলামকে স্বাধীন করে দিয়ে মাটি থেকে এক খণ্ড কাঠ অথবা অন্য কিছু হাতে নিয়ে বলেন: এর মধ্যে আমার জন্য এমন কোনো প্রতিদান নেই, যা এর সমান হতে পারে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“যে ব্যক্তি তার গোলামকে চড় মারলো অথবা প্রহার করলো, তবে তার কাফ্‌ফারা হলো তাকে মুক্ত করে দেওয়া।” (আবূ দাউদ, আদব, বাব নং- ১৩৪, হাদীস নং- ৫১৭০ ; মুসলিম, আইমান, বাব নং- ৮, হাদীস নং- ৪৩৮৮)।

৩. দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে মর্যাদাবান গোলামকে স্বাধীন ব্যক্তির উপর প্রাধান্য দেওয়া:

সালাতে গোলামের ইমামতি করাটা বৈধ। উম্মুল মুমেনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার একজন গোলাম ছিলো, সে সালাতে তাঁর ইমামতি করতো … এমনকি মুসলিমগণকে গোলামের কথা শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছেযখন সে তাদের শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং অন্যদের থেকে অধিক যোগ্য হয়

স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার; আপতিত কোনো কারণ ব্যতীত কোনো ব্যক্তির এই অধিকার হরণ করা যায় না। আর ইসলাম যখন দাসপ্রথাকে নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে গ্রহণ করেছে (যা আমরা পরিষ্কারভাবে আলোচনা করেছি), তখন ইসলাম সেই মানুষকে দাস করেছে, যে তার স্বাধীনতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করেছে। ফলে যখন সে কোনো সীমালঙ্ঘনের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর যুদ্ধবন্দী হবে, তখন তাকে যুদ্ধবন্দিত্বের সময়কালীন আটক রাখা একটি সঠিক আচরণ।

আর যখন কোনো কারণে মানুষ দাস-দাসীতে রূপান্তরিত হয়; অতঃপর যখন তার পথভ্রষ্টতা থেকে ফিরে আসে, তার অতীতকে সে ভুলে যায় এবং সে এমন মানুষ হয়ে যায় যে অপকর্ম থেকে দূরে ও সৎকর্মের নিকটবর্তী, তখন তার স্বাধীনতা লাভের আবেদন মঞ্জুর করা হবে কি?

ইসলাম তার আবেদন মঞ্জুর করার পক্ষে অভিমত পেশ করে; ফিকাহবিদগণের কেউ কেউ এই আবেদন মঞ্জুর করাকে আবশ্যক মনে করেন এবং কেউ কেউ এই আবেদন মঞ্জুর করারকে মুস্তাহাব (পছন্দনীয়) মনে করেন।

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসদের ব্যাপারে অনেক ওসিয়ত করেছেন। এ কথা প্রমাণিত যে, তিনি যখন সাহাবাদের মাঝে বদরের যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীদের বণ্টন করেন, তখন তিনি তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন:

“استوصوا بالأسرى خيراً”

তোমরা যুদ্ধবন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর।[৩]

বর্ণিত আছে যে, উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোনো অপরাধ করার কারণে তাঁর গোলামের কান মলে দিয়েছিলেন; অতঃপর তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে পরবর্তীতে বললেন: তুমি আসোঅতঃপর আমার কানে চিমটি কাটো কিন্তু গোলাম তাতে অপারগতা প্রকাশ করলো; তখন তিনি তাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, তারপর সে হালকাভাবে কানে চিমটি কাটতে শুরু করলো। তখন তিনি তাকে বললেন: ভালো করে চিমটি কাটো; কেননা আমি কিয়ামতের দিনের শাস্তি ভোগ করতে পারব না। তখন গোলাম বললো: হে আমার মনিব! আপনি যেই দিনকে ভয় করেন, অনুরূপভাবে আমিও তো সেই দিনকে ভয় করি।

আবদুর রহমান ইবন ‘আউফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন তাঁর গোলামদের সাথে হাঁটতেন, তখন কেউ তাঁকে পৃথক কেউ ভাবতে পারতেন না কেননা তিনি তাদের সামনে চলতেন না এবং তারা যেই পোশাক পরিধান করতো, তিনিও সেই পোশাক পরিধান করতেন।

আর ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোনো একদিন মক্কার পথ অতিক্রম করছিলেন, অতঃপর তিনি গোলামদেরকে তাদের মনিবদের সাথে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন; তখন তিনি রাগ হয়ে তাদের অভিভাবকদেরকে বললেন: এই জাতির কী হলো যেতারা তাদের খাদেমদের উপর নিজেদেরকে প্রাধান্য দেয়তারপর তিনি খাদেমদেরকে ডাকলেন, তারা তাদের সাথেই খাওয়া-দাওয়া করলো।

আর জনৈক ব্যক্তি সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট প্রবেশ করলে সে তাঁকে ময়দার খামির তৈরি করতে দেখলো, তখন বললো: হে আবূ আবদিল্লাহ! এ কী হচ্ছে? অতঃপর তিনি বললেন: আমরা খাদেমকে এক কাজে পাঠিয়েছি এবং আমরা তার উপর দুটি কাজ এক সাথে চাপিয়ে দিতে অপছন্দ করলাম।

এটা হলো ইসলাম দাস-দাসীদেরকে যে অনুগ্রহ ও করুণা দেখিয়েছে, তার কিছু নমুনা।

দাস-দাসীর ব্যাপারে ইয়াহুদীদের অবস্থান:

ইয়াহূদীদের নিকট মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত: এক ভাগ হলো ইসরাঈল সম্প্রদায়; আর অপর ভাগ হলো বাকি সকল মানুষ।

আর ইসরাঈল সম্প্রদায়, তাদের বাইবেলের পুরাতন নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত কিছু শিক্ষা সাপেক্ষে তাদের কাউকে দাস-দাসী বানানোর বৈধতা রয়েছে। আর তারা ব্যতীত অন্যরা হলো নীচু বা অধঃপতিত জাতি, তাদেরকে বন্দী ও জোর-জবরদস্তী করে দাস-দাসী বানানো সম্ভব; কেননা তারা এমন বংশধর, যাদের কপালে আদিকাল থেকে লাঞ্ছনা ও অপমান লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাওরাতের প্রস্থান পর্বে (২১: ২-১১) এসেছে:

“যখন তুমি কোনো ‘ইবরানী (হিব্রু জাতির) গোলাম ক্রয় করবে, তখন সে ছয় বছর খেদমত করবে এবং সপ্তম বছরে সে বিনা খরচে স্বাধীন হয়ে বেরিয়ে যাবে। সে যদি একা প্রবেশ করে, তবে সে একাই বের হয়ে যাবে; আর সে যদি কোনো স্ত্রীর স্বামী হয়, তবে তার সাথে তার স্ত্রীও বের হয়ে যাবে; যদি তার মনিব তাকে কোনো স্ত্রী দান করে এবং তার থেকে তার সন্তান-সন্ততির জন্ম হয়, তবে স্ত্রী ও তার সন্তানগুলো মনিবের হয়ে যাবে এবং সে একা বের হয়ে যাবে; কিন্তু গোলাম যখন বলবে: আমি আমার মনিব, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদেরকে ভালোবাসি, আমি তাদেরকে ছেড়ে স্বাধীন হয়ে বের হয়ে যাবো না— তখন তার মনিব তাকে ঈশ্বরের নিকট পেশ করবে এবং সে দরজা বা দরজার চৌকাঠের কাছে তাকে নিয়ে তুরপুন দিয়ে তার কান ছিদ্র করে দেবে, তাতে সে সারা জীবন তার মালিকের গোলাম হয়ে থাকবে। আর যখন কোনো ব্যক্তি তার কন্যাকে দাসী হিসেবে বিক্রয় করবে, তবে সে গোলামদের মতো স্বাধীন হয়ে বের হতে পারবে না; কিন্তু যে মনিব তাকে নিজের জন্য পছন্দ করে নিয়েছে সে যদি তার উপর খুশি হতে না পারে, তবে তাকে টাকার বদলে ছেড়ে দিতে হবে। অন্য জাতির কোনো লোকের কাছে তাকে বিক্রি করা চলবে না; কারণ তার প্রতি মনিব তার কর্তব্য করেনি। আর যদি মনিব তার ছেলের জন্য তাকে প্রস্তাব দিয়ে থাকে, তবে সে তার কন্যাদের অধিকার অনুযায়ী তার সাথে ব্যবহার করবে। যদি সে তার নিজের জন্য অন্য কোনো দাসীকে গ্রহণ করে, তবে সে তার ভরণ-পোষণ ও আচার-ব্যবহারে কোনোরূপ ঘাটতি করবে না। যদি সে তার সাথে এই তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতি অবলম্বন করতে ব্যর্থ হয়, তবে সে বিনামূল্যে কোনো বিনিময় ছাড়াই তাকে চলে যেতে দিতে হবে।”

যদি ‘ইবরানী (হিব্রু জাতি) ভিন্ন অন্যদেরকে দাস-দাসী বানানো হয় তবে তা হবে বন্দী করে ও জোর খাটিয়ে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে যে, মর্যাদার দিক থেকে তাদের জাতি অন্যান্য জাতির চেয়ে অনেক উপরে। তারা দাসত্ব প্রতিষ্ঠার এই পদ্ধতির ব্যাপারে তাদের তাওরাত থেকে দলীল পেশ করে বলে: নূহের ছেলে হাম[৪] তার পিতাকে ক্রোধান্বিত করেছিলো; কেননা নূহ কোন একদিন নেশা করেছিলো, অতঃপর সে ঘুমন্ত অবস্থায় উলঙ্গ হয়ে গেলো, অতঃপর হাম এই অবস্থায় তাকে দেখে ফেললো, অতঃপর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে যখন নূহ এই ব্যাপারটি জানতে পারলো, তখন সে রেগে গেলো এবং তার বংশধরকে অভিশাপ দিলো, যারা কেনানের বংশধর বলে পরিচিত। আর তিনি বলেন (যেমনটি তাওরাতের সৃষ্টি পর্বের ৯: ২৫-২৬ -এ উল্লেখ আছে):

“ ‘কানান অভিশপ্ত হোক! সে নিজের ভাইদের দাসানুদাস হবে।’ সে আরও বললো: ‘ধন্য হোক শেমের পরমেশ্বর! কানান তার দাস হোক!’ ”

আর একই অধ্যায়ে বলা হয়েছে (৯:২৭) :

“পরমেশ্বর যাফেথকে বিস্তৃত করুন, শেমের তাঁবুতে বাস করুক। আর কানান তার দাস হোক!”

বৃটেনের রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই ভাষ্যের সূত্র ধরেই দাস-ব্যবসাকে বৈধ মনে করেন এবং এ ক্ষেত্রে অনেক ‘অবদান’ রাখেন। বিষয়টি সামনে আলোচিত হবে।

দাস-দাসীর ব্যাপারে খ্রিষ্টানদের অবস্থান:

ইয়াহূদী ধর্মের পর খ্রিষ্টধর্মও দাসপ্রথাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। ইঞ্জিলের নতুন নিয়মে (New Testament) একটি বক্তব্যও নেই, যা দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করে অথবা তার প্রতিবাদ করে।

অদ্ভুত বিষয় হলো, ঐতিহাসিক উইলিয়াম ম্যুর আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই বলে দোষারোপ করে যে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে দাসপ্রথা বাতিল করেননি; অথচ ঐতিহাসিক সাহেব দাসপ্রথার ব্যাপারে ইঞ্জিলের অবস্থান বেমালুম চেপে গেছেন। তিনি মাসীহ, হাওয়ারীগণ এবং গির্জা থেকে এই ব্যাপারে কোনো কিছুই বর্ণনা করেননি।

বরং ‘পল’ তাঁর পত্রসমূহে দাসদেরকে আন্তরিকতা সহকারে তাদের মনিবদের খেদমত ও সেবা করার নির্দেশ দিতেন, যেমন তিনি এফেসীয়দের নিকট প্রেরিত পত্রে বলেছেন।

আর সাধক ও দার্শনিক ‘থমাস অ্যাকুইনাস’ ধর্মীয় নেতাদের চিন্তাধারার সাথে দার্শনিক চিন্তাধারা একত্রিত করেছেন। তিনি দাসপ্রথার প্রতিবাদ করেননি, বরং তিনি এর প্রশংসাই করেছেন। কারণ, তাঁর গুরু এরিস্টটলের চিন্তাধারা অনুযায়ী দাসত্ব এমন এক স্বভাবগত অবস্থার নাম, যে প্রাকৃতিক স্বভাব দিয়ে কিছু মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

আর সাধকগণও স্বীকার করেছেন যে, প্রকৃতিই কিছু মানুষকে দাস-দাসী বানিয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বৃহৎ এনসাইক্লোপিডিয়া ‘লারুস’ –এ আছে: “খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীদের মাঝে আজ পর্যন্ত দাসপ্রথা অবশিষ্ট ও চলমান থাকার কারণে মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করে না। কারণ, আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় প্রতিনিধিগণ এই প্রথাকে বিশুদ্ধ বলে স্বীকৃতি প্রধান করেন এবং তা বিধিসম্মত বলে মেনে নেন।”

এতে আরও বলা হয়েছে: “সারকথা হলো, খ্রিষ্টধর্ম আজ পর্যন্ত দাসপ্রথাকে সন্তুষ্ট চিত্তে বিধিসম্মত মনে করে; আর মানুষের পক্ষে এ কথা প্রমাণ সম্ভব নয় যে, খ্রিষ্টধর্ম দাসপ্রথা বাতিল করার চেষ্টা করেছে।”

ডক্টর জর্জ ইউসূফের কামুস আল-কিতাব আল-মুকাদ্দাস (قاموس الكتاب المقدس) -এ এসেছে:

“খ্রিষ্টধর্ম রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ কিংবা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ কোনো দিক থেকেই দাসপ্রথার প্রতিবাদ করেনি; তা বিশ্বাসীদেরকে দাসত্ব সম্পর্কিত আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের প্রজন্মের আচরণ পরিত্যাগ করতেও বলেনি, এমনকি এই প্রসঙ্গে কোনো আলোচনাও উৎসাহিত করেনি। তা দাস মালিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি; আর দাসদের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যেও কোনো আন্দোলন করায়নি। তা দাসপ্রথার ক্ষতি ও নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে কোনো আলোচনা করেনি; আর তাৎক্ষণিকভাবে দাসমুক্তির নির্দেশও দেয়নি। মোটকথা, তা দাস ও মনিবের মধ্যকার আইনী সম্পর্কের কোনো কিছুর পরিবর্তন করেনি; বরং এর বিপরীতে তারা উভয় দলের অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।”

আমরা হোয়াইটি ফাদার্স সংগঠনের সকল খ্রিষ্টান ও সম্মানিত পাঠক সমাজকে আহ্বান করছি, তাঁরা যেন ইসলামের শিক্ষা ও এই শিক্ষার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ও পর্যালোচনা করে দেখেন।

আধুনিক ইউরোপ ও দাসপ্রথা:

রেনেসাঁ ও প্রগতির যুগে অবস্থানকারী পাঠকের এই অধিকার আছে যে, এই যুগের প্রগতির অগ্রদূত (যেমন বলা হয়ে থাকে) সম্পর্কে জানতে চাইবে যে, দাসপ্রথার ব্যাপারে সে কী করেছে।

যখন ইউরোপের সাথে কৃষ্ণ আফ্রিকার যোগাযোগ হলো, তখন এই যোগাযোগ ছিলো মানবতার জন্য হৃদয়বিদারক ঘটনা, যার ফলে এই মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গরা দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দী কাল ধরে ভয়াবহ বিপদ ও মুসিবতের সম্মুখীন হয়েছিলো। ইউরোপের দেশগুলো সুসংগঠিত করেছে এবং তারা তাদেরকে তাদের নিজেদের দেশের সাথে টেনে নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের নিকৃষ্ট চিন্তাধারা প্রকাশ করেছে, যাতে তারা তাদের জাগরণ ও রেনেসাঁর ইন্ধন হতে পারে এবং তারা নিজেরা যে কাজের সামর্থ্য রাখে না সে কাজের বোঝা তাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। পরবর্তীতে যখন আমেরিকা আবিষ্কৃত হলো, তখন এক মহাদেশের পরিবর্তে দুই মহাদেশ সেবা করার বোঝা বহনের কারণে তাদের বিপদ ও মুসিবত আরও বেড়ে গেলো।

এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ২য় খণ্ডের ৭৭৯ পৃষ্ঠায় SLAVERY শিরোনামে বলা হয়েছে:

“জঙ্গল বেষ্টিত গ্রামসমূহ থেকে দাস-দাসী শিকারের কাজ সম্পন্ন হতো ঐসব বিখণ্ডিত শুষ্ক উদ্ভিদে আগুন প্রজ্বলিত করার মাধ্যমে, যার থেকে গ্রামকে ঘিরে রাখার জন্য বেড়া বানানো হতো। শেষপর্যন্ত যখন গ্রামবাসী নির্জন এলাকায় বের হয়ে যেত, তখন ইংরেজগণ তাদের জন্য তৈরি করা ফাঁদের মাধ্যমে তাদেরকে শিকার করতো।”

এই শিকার পদ্ধতির কারণে এবং ইংরেজ ও অন্যান্য কোম্পানির জাহাজ সমুদ্র তীরে নোঙ্গর করার পথে যারা মারা যেত, তারা ব্যতীত বাকি এক তৃতীয়াংশ মারা যেত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে। আর ৪৫% মারা যেত জাহাজে বোঝাই করার সময়ে এবং ১২% মারা যেত সফরে। আর তাদের উপনিবেশে যারা মারা যেত, তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

আর বৃটেন সরকার কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স নিয়ে এই দাসব্যবসায় কিছু ইংরেজ কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। পরবর্তীতে বৃটেনের সব প্রজাদের হাতে দাসব্যবসা করার অধিকার প্রদান করা হয়। ১৬৮০-১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে বৃটিশ অধিকৃত ও বিভিন্ন উপনিবেশে দাস হিসেবে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতানুসারে ২১৩০০০০ (একুশ লক্ষ ত্রিশ হাজার) ছিলো।

আর এই ব্যাপারে তাদের কালো আইনগুলোর অন্যতম হলো: যে দাস তার মনিবের উপর আক্রমণ করে, তাকে হত্যা করা হবে। আর যে পালিয়ে যাবে, তার দুই হাত ও দুই পা কেটে ফেলা হবে এবং তাকে উত্তপ্ত লোহা দ্বারা সেঁক দেয়া হবে; আর যখন সে দ্বিতীয়বারের মতো পলায়ন করবে, তখন হত্যা করা হবে।

আমার জানা নেই যে, হাত-পা কেটে ফেলার মতো শাস্তি দেওয়ার পরেও দ্বিতীয় বার কীভাবে সে পলায়ন করবে! সম্ভবত সে যে নরকে বাস করতো, তা তার হাত-পা কাটার চাইতেও আরও ভয়াবহ ছিলো, যার ফলে সে দ্বিতীয়বার পালানোর চেষ্টা করতো।

আর তাদের আইনগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো: কৃষ্ণাঙ্গদের শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ; আর কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য শ্বেতাঙ্গদের চাকুরি নিষিদ্ধ।

আমেরিকার আইন-কানুনসমূহের মধ্যে আছে: যখন সাতজন দাস এক জায়গায় একত্রিত হবে, তখন তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং শ্বেতাঙ্গরা যখন তাদের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করবে, তখন তাদের জন্য তাদেরকে থুথু দেওয়া ও বিশটি করে বেত্রাঘাত করা বৈধ হবে।

আর অপর একটি আইনের ভাষ্য হলো: দাসদের আত্মা বা রূহ বলতে কিছু নেই, তাদের নেই মেধা, বিচক্ষণতা ও ইচ্ছাশক্তি; আর তাদের জীবনের অস্তিত্ব শুধু তাদের বাহুতেই আছে।

এই ব্যাপারে সারকথা হলো, দাস-দাসীগণ দায়িত্ব-কর্তব্য, সেবা ও ব্যবহারের দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধিমান ও জবাবদিহিতার অধীন, কোনো কিছুর ঘাটতি হলেই তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু অধিকারের বেলায় সে হলো এমন বস্তুর নাম, যার কোনো প্রাণ ও অস্তিত্ব নেই; বরং আছে তার শুধু দুই বাহু বা হাত!

এভাবেই তাদের হৃদয় এই শেষ শতাব্দীতে এসে কিছুটা সঠিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। আর যে কোনো ন্যায়পরায়ণ লোক এর মধ্যে ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চৌদ্দ শতাব্দী কালেরও বেশি সময় ধরে চলমান ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করবে, সে উপলব্ধি করতে পারবে যে, এ বিষয়টিতে ইসলামকে ঢুকানোর চেষ্টার ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত সে উপমাটি অধিকতর প্রযোজ্য: উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে!

তথ্যসূত্র

[১]  বদর মদীনার নিকটবর্তী একটি গ্রামের নাম।

[২]  ‘রবযা’ মদীনার নিকটবর্তী একটি গ্রামের নাম।

[৩]  ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসদাসী স্বাধীন করার সাওয়াব বর্ণনা করে আরও বলেন: “যে কেউ কোনো দাস বা দাসী স্বাধীন করবে, আল্লাহ্ তাকে তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন।” [বুখারী ও মুসলিম]

কুরআনুল কারীমেও জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য দাসমুক্তিকে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করে বলা হয়েছে: “তবে সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। আর কীসে আপনাকে জানাবে — বন্ধুর গিরিপথ কী? এটা হচ্ছে: দাসমুক্তি…” [সূরাহ আল-বালাদ(৯০): ১১-১৩] — সম্পাদক।

[৪]  হাম হলো কেনানের পিতা।


লেখক: শাইখ সালেহ ইবন আবদুল্লাহ আল-হুমাইদ

অনুবাদ : ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive